মুফদি আহমেদ : শিল্প পুলিশের তথ্য মতে, পোশাক খাতের ৪ হাজার কারখানার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ কারখানায় শ্রমিকদের ঈদ বোনাস দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখনও বাকি রয়েছে ২০ শতাংশ কারখানার শ্রমিকদের বোনাস। রাজধানীর কাফরুল এলাকার একটি ভবনে কাজ করতেন ফরিদা বেগম (৩০)। গতবছর দ্বিতীয় দফায় করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পর কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে যান। এরপর গতবছরের শেষদিকে কাজের সন্ধানে আবারও ফিরে আসেন রাজধানীতে। যোগ দেন মিরপুরের একটি গার্মেন্টস কারখানায়। দু’একদিন পরই ঈদ-উল-ফিতর। কিন্তু এখনও বেতন ও বোনাস কিছুই জোটেনি ফরিদার ভাগ্যে। বেতন-বোনাস পেলে গ্রামের বাড়িতে যাবেন এমন আশায় দিন গুণছেন তিনি। শাহিদার মতো অনেক শ্রমিক এখনও মার্চের বেতন পাননি। এপ্রিল মাসের ১৫ দিনের বেতন দেয়ার কথা থাকলেও সেটিও পাননি অনেক শ্রমিক। জমা হয়নি উৎসবের বোনাসও। কল-কারখানায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকিতে নিয়োজিত শিল্প পুলিশের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৩০ শতাংশ কারখানার পোশাক শ্রমিকদের ঈদ বোনাস এবং ৭০ শতাংশ কারখানার শ্রমিককে এপ্রিল মাসের ১৫ দিনের বেতন দেয়নি মালিকরা। এমন বাস্তবতায় আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। যেন উৎসবেও দুর্দশায় মোড়ানো শ্রমিকদের জীবন।
আর সরকারী নির্দেশনা অনুসারে, গত ২৮ এপ্রিলের মধ্যে শ্রমিকদের ন্যূনতম এপ্রিল মাসের প্রথম ১৫ দিনের বেতন দেয়ার কথা ছিল। শনিবার পর্যন্ত ৯০ শতাংশ কারখানা মালিকরা বেতন দিয়েছে। এ কারখানাগুলো তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, নিটওয়্যার কারখানা মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ), বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) সদস্যভুক্ত। তবে পোশাক খাতের বাইরে চামড়াজাত পণ্য, আসবাব, সেলফোন সংযোজন, ওষুধপণ্যসহ অন্যান্য খাতের কারখানা রয়েছে মোট ৬ হাজার। এই কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের কী পরিমাণ বেতন ও বোনাস দেয়া হয়েছে, তার সঠিক কোন তথ্য নেই শিল্প পুলিশের কাছে। এ বিষয়ে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত অধিকাংশ কারখানায় বেতন ও বোনাস পরিশোধ করা হয়ে গেছে। অল্প কিছু কারখানায় বাকি রয়েছে, ঈদের আগেই বেতন ও বোনাস পরিশোধ হয়ে যাবে। ঈদের আগে কোন শ্রমিকের বেতন ও বোনাস বাকি থাকবে না। জানতে চাইলে শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, আমরা শঙ্কায় ছিলাম, এবার সময়মতো বেতন-বোনাস পাবেন না শ্রমিকরা। বাস্তবেও তাই ঘটল। তিনি বলেন, বড় গামেন্টসগুলো বেতন বোনাস দিয়েছে, কিন্তু ছোট গামেন্টস শ্রমিকদের বেতন বোনাস দেয়নি। সরকারের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভা প্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, রানা প্লাজা ভবন ধসে আহত পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে ২০১৯ সালে বেকার ছিলেন ৫১ শতাংশ। গত দুই বছরের করোনাকালে সেটি বেড়ে ৫৭ শতাংশ হয়েছে, যা গত ছয়বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, করোনার বিভিন্ন সময়ের লকডাউনে শ্রমিকদের বেতন কাটা, ছাঁটাই এবং লেঅফে শ্রমিকদের জীবন ছিল বিপর্যস্ত। কাজ হারায় সাড়ে ৩ লাখের বেশি শ্রমিক। বহু শ্রমিক কাজ ছেড়ে গ্রামে গেছে কিংবা বেকার হয়েছে। এখনও কোন কোন কারখানার শ্রমিক তাদের বকেয়া বেতন পায়নি। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে লাখ লাখ শ্রমিক সমবেত কণ্ঠে দাবি তুলেছিলেন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত নয়, আট ঘণ্টা কর্মদিবস চাই। শ্রমিকদের গুলি করে হত্যার মাধ্যমে সেই আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে দমন করাই শুধু নয়, আন্দোলনের নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। ১৯১৯ সালে আইএলও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সারাবিশ্বে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। শ্রম দাসত্ব থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে শ্রমজীবী মানুষ গভীর আবেগে মে দিবস পালন করে। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর থেকেই মে দিবস সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে গণমাধ্যমগুলোও বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে।
জানা যায়, মে দিবসের প্রধান দাবি আট ঘণ্টা কর্মদিবস দেশের ২২ লাখ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হলেও কোটি কোটি বেসরকারী শ্রমিক সেই সুফল পান না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তি ছয় কোটি আট লাখ। এরমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে (শ্রম আইনের সুবিধা পান) কর্মরত জনশক্তি মাত্র ১৪.৯ শতাংশ। সবচেয়ে বড় অংশ ৮৫.১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। এই হিসাবে দেশের পাঁচ কোটি মানুষ দিনমজুরের মতো কাজ করে, যাদের শ্রম আইন-২০০৬ প্রদত্ত নিয়োগপত্র, কর্মঘণ্টা, ঝুঁকি ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, বাড়িভাড়াসহ বেশিরভাগ অধিকারই নিশ্চিত নয়। মালিকপক্ষের ইচ্ছায় তাদের কাজ ও মজুরি নির্ধারণ হয়ে থাকে। একাধিক শ্রমিক সংগঠনের দেয়া তথ্য মতে, শ্রম আইন নির্ধারিত মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ৪৩টি সেক্টরের সোয়া কোটি শ্রমজীবীর নি¤œতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি লাখ লাখ শ্রমিককে ‘কাজ নাই তো মজুরি নাই’ নীতিতে কাজ করানো হয়ে থাকে। ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক নির্মাণ খাতে, ৭০ লাখ পরিবহন খাতে, তিন লাখ পাট খাতে এবং ১০ লাখের বেশি দোকান কর্মচারী, চা, চামড়া, তাঁত, রি-রোলিং, মোটর মেকানিক, লবণ, চিংড়ি, সংবাদমাধ্যম, হাসপাতাল-ক্লিনিক, পুস্তক বাঁধাই, হকার, রিক্সা-ভ্যানচালক, ইজিবাইক চালক, সিকিউরিটি গার্ডসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন।
শ্রমিক নেতারা জানান, শ্রমিকদের আয়ের বড় অংশ খাদ্য, বাড়িভাড়া, পোশাক ও চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে যাওয়ার ফলে সঞ্চয় যেমন থাকছে না, তেমনি দক্ষতা অর্জনের জন্য বাড়তি খরচ করাও শ্রমিকের জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না। এরপর শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তো রয়েছেই। সাভারে রানা প্লাজা ধস ও তাজরীনসহ বিভিন্ন কারখানার অগ্নিকা- শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি সামনে এনে দিয়েছে। সর্বশেষ করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই দুর্যোগ শ্রমিকদের অসহায়ত্বের বিষয়টি বিশ্ববাসীর সামনে স্পষ্ট করে তুলেছে। এসব ক্ষেত্রে মালিকের মুনাফার শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা।
ন্যূনতম মজুরি নেই ৪৭ শিল্প খাতে ॥ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর (ডিআইএফই) থেকে দেশের সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স নিতে হয়। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন এই সংস্থা এ পর্যন্ত ৫৪টি শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে। এর বাইরে বিবিধ তালিকায় আরও অন্তত ৫০টি শিল্প খাতকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এই ১০২টি শিল্পের মধ্যে মজুরি বোর্ড মাত্র ৪৭টি শিল্পে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ এখনও বাকি ৫৭টি শিল্পের শ্রমিকরা ন্যূনতম ঘোষিত মজুরির বাইরে রয়েছেন। মজুরি বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আরও তিনটি শিল্পের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ নিয়ে এখন কাজ চলছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট ছয় কোটি ৭০ হাজার মানুষ শ্রমবাজারে নিয়োজিত।