বিডি ঢাকা স্টাফ রিপোর্টার
তেয়াত্তর (৭৩) বছর বয়সেও কাঁচা সবজি বিক্রি করে স্বামী-স্ত্রী দুই জনের সংসার চালায় নেফাউর রহমান। নিজের ভিটেমাটিও লিখে দিয়েছেন দুই ছেলের নামে। সেই জমিতে পুরাতন জরাজীর্ণ বাড়িতে বসবাস করতেন নেফাউর রহমান ও তার স্ত্রী সোনাভান বেগম। প্রবাসী ছোট ছেলে দেশে ফিরেছেন। দেশে ফিরেই বাবার সবজি দোকান নিতে চাই কোটিপতি ছেলে। দোকান না দেয়ায় বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন সেই ছেলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ঘোড়াপাখিয়া ইউনিয়নের ধূমিহায়াতপুর গ্রামের নেফাউর রহমানের ছেলে আলম আলী (৪২) তার বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা আলম আলী কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন আলিসান দোতলা বাড়ি। তার পাশেই আরেক ভাই
ব্যবসায়ী কালামের পাঁকা বাড়ি। কিন্তু এই দুই বাড়ির কোনটিতেই জায়গা হয়নি নেফাউর-সোনাভান দম্পতির। বসবাস করেন পুরাতন জরাজীর্ণ বাড়িতে। স্থানীয় বাসিন্দা, নেফাউর ও তার পরিবার-স্বজন সূত্রে জানা যায়, দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক নেফাউর রহমান দীর্ঘদিন ধরে কাঁচা সবজি বিক্রি করেন পাশের গ্রামের ইংলিশ মোড়ে। সেখানে তার একটি দোকান রয়েছে। এই সবজির দোকান চালিয়ে সংসার চলে দুইজনের। দোকানে থাকা কর্মচারীর কারনে কয়েক দফা লোকসান করেছেন নেফাউর রহমান। এদিকে, কোটিপতি প্রবাসী ও ব্যবসায়ী ছেলেরা বাবা-মায়ের সংসার চালাতে কোনরকম খরচ দেন না। সবমিলিয়ে অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে সংসার চলে তাদের। সম্প্রতি দেশে ফিরে বাবার দোকান নেয়ার দাবি করেন প্রবাসী ছেলে আলম। কিন্তু আর অন্য কোন আয়ের উৎস না থাকায় বাধ্য হয়েই ছেলেকে দোকান দিতে নারাজ বাবা নেফাউর রহমান। গত ১০ সেপ্টেম্বর দোকান না দেয়ায় বাবাকে বাড়ি থেকে
চলে যেতে বলেন আলম। না গেলে খবর আছে বলে হুমকি দিলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান নেফাউর-সোনাভান দম্পতি। আশ্রয় নেন সোনাভানের ভাইদের বাড়িতে। বৃদ্ধ নেফাউর রহমান বলেন, আমার ভিটেমাটি যা ছিল তা ৩০-৩৫ বছর আগে দুই ছেলেকে দেড় কাঠা করে লিখে দিয়েছি। এক ছেলে কালাম তার ভাইয়ের কাছে তার ভাগের জমি বিক্রি করে দেয়ায় পুরো জমির মালিক আলম। সেই ভিটেমাটিতেই আমরা স্বামী-স্ত্রী পুরাতন বাড়িতে বসবাস করি। দুই ছেলে পুরাতন বাড়ির কয়েকশ গজ দূরে আলিসান করে বাড়ি তৈরি করেছে। সেখানে তারা স্ত্রী ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করে। তিনি আরও বলেন, দুই ছেলে আমাদের সংসারে কোন খরচ দেয় না। আমি সবজির দোকান চালিয়ে যা উপার্জন করি, তা দিয়ে আমাদের দুইজনের সংসার চলে। ছোট ছেলে আলম দেশে ফিরে আমার দোকান নিতে চাই। আমার আর কোন উর্পাজনের
উপায় নেই। তাই দোকান ছাড়তে চাইনি। পরে গত ১০ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে বাড়িতে এসে বলে দোকান দিবে না, তাহলে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। না হলে খবর আছে। নেফাউর রহমান বলেন, ছেলের হুশিয়ারী শুনে খালি গায়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কারন সে সাথে করে লোকজন নিয়ে এসেছিল। কোন প্রতিবাদ করিনি। কারন প্রতিবাদ করলে মারধরও করতে পারে এমন মনে হয়েছিল। পুলিশের জরুরি সহায়তা ফোন নাম্বার ৯৯৯ এ ফোন দিলে তারা থানায় গিয়ে অভিযোগ দিতে বলেন। কিন্তু ছেলেতে যতোই অপরাধ করুক, বাড়ি থেকে বের করে দেক না কেন, আমি আর কারোও কাছে অভিযোগ দেয়নি। আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুক। তারা ভুল করতে পারে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। বৃদ্ধা সোনাভান বেগম জানান, আমার স্বামী বারবার সবজির ব্যবসায় লস করে। তাই
ছেলে দোকান নিতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বামী দিতে রাজি হয়নি। এনিয়ে কথা কাটাকাটি হলে একপর্যায়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে আমার ছেলে। পরে স্বামী-স্ত্রী আমার ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানে দুই দিন থাকার পর আমি পুরাতন বাড়িতে ফিরে আসলেও স্বামী আসেনি। নেফাউর রহমানের ছোট ভাই এরফান আলী বলেন, দোকান না দেয়ার কারনে আমার বৃদ্ধ ভাইকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে ভাতিজা। দুইদিন পর মা ফিরে আসলেও ভাই কষ্ট হতাশা নিয়ে শ্যালকদের বাড়িতে থেকে গেছে। আমরা ভাতিজা কাজটা ঠিক করেনি। তার যখন ১০ বছর বয়স তখন তার বাবা তাকে জমিগুলো লিখে দিয়েছে। এমনকি বিদেশ যাওয়ার সময়ও বিভিন্ন জায়গা থেকে ধারদেনা করে পাঠিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রতিবেশী জানান, ১০ দিন থেকে বাড়ির বাইরে নেফাউর রহমান। পরে গতকাল (বুধবার ২১ সেপ্টেম্বর) এলাকার লোকজনের চাপে ও সাংবাদিকরা ঘটনা জেনে গেছে শুনে বাবাকে পুরাতন বাসায়
ডেকে এনেছে। বৃদ্ধ বয়সে বাপ-মাকে না দেখে উল্টো বাড়ি থেকে বের করে দেয়া তাদের অন্যায় হয়েছে। স্থানীয় যুবক সুমন আলী বলেন, ছোট থেকেই দেখছি বৃদ্ধ নেফাউর রহমান সবজি বিক্রি করেন। ছেলেকে অনেক কষ্টে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আলম বিদেশে গিয়ে হুন্ডি ও সুদের ব্যবসা করে বিপুল পরিমাণ টাকার মালিক হয়েছেন। জমি কেনার পাশাপাশি আলিসান করে কোটি টাকার দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। অথচ সেই বাড়িতে বাবা-মায়ের জন্য থাকার জায়গা হয়নি। এমনকি বাবা-মায়ের সংসার চালাতে কোন খরচ বহন করেন না। উল্টো বাড়ি থেকেই বের করে দিয়েছেন। এবিষয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার কথা স্বীকার
করে আলম আলী জানান, আমার বাবা বারবার সবজির ব্যবসায় লোকসান করে। তাই তাকে সবজির দোকানটি আমার কাছে দিতে বলি। এনিয়ে কথা কাটাকাটি হলে বাসা থেকে চলে গেছে। তবে জোরপূর্বক বের করে দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। এবিষয়ে ঘোড়াপাখিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মামুন-অর-রশীদ মমিন বলেন, আমার জানা মতে, নেফাউর রহমানের দুই ছেলেই ভালো ও আর্থিক দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে, নেফাউর রহমান একটু রগচটা। সে একটি সবজির দোকান চালিয়ে সংসারের ব্যয় বহন করে। কিন্তু তার ছেলে আলম তার দোকান নেয়ার বিনিময়ে মাসিক কিছু খরচ দিতে চেয়েছিল। এনিয়ে কিছুটা বনিবনা না হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।