শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩২ অপরাহ্ন

ইভিএম এখন ইসির গলার কাঁটা, গচ্চা ৪ হাজার কোটি টাকা

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪
  • ১৫ বার পঠিত

বিডি ঢাকা ডেস্ক

 

 

‘ভোট জালিয়াতির সাদা হাতি’ হিসেবে পরিচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বিপাকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। এর পেছনে সরকারের গচ্চা গেছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থব্যয় ছাড়া তেমন কোনো কাজেই লাগেনি এই মেশিন। এসংক্রান্ত প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে গত ৩০ জুন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এর প্রয়োজনও ফুরিয়েছে বলে মনে করছেন ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। কিন্তু পড়ে থাকা দেড় লাখ মেশিনের এখন কী গতি হবে, সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোনো ধারণা নেই।

ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন যে ইভিএমগুলো আছে, তা নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।

এ বিষয়ে মিডিয়ার সঙ্গে আমি আর কথা বলতে চাই না।’

নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম জানান, প্রকল্প থেকে কেনা হয়েছিল দেড় লাখ ইভিএম। এর মধ্যে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন নির্বাচন অফিসে আছে ৬১ হাজার ২২০টি, রাজধানী ঢাকার নির্বাচন ভবনের কাস্টমাইজেশন সেন্টারে আছে ৬১৮টি, আর বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ) আছে সাড়ে ৮৬ হাজারের মতো। আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে ১৫৭টি।

যেগুলো আছে সেগুলো কী অবস্থায় আছে তা পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া ইভিএমগুলো সংরক্ষণ করে রাখলে তার জন্য গোডাউনের প্রয়োজন হবে। বিএমটিএফে যেগুলো আছে, তার জন্য ব্যয়ের পরিমাণও কম নয়।

তিনি বলেন, ‘ইভিএমগুলো বিনা ব্যয়ে বুঝে নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা কমিশনকে প্রকল্পের মেয়াদ ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি।

সে কারণে প্রকল্পের মালপত্র হস্তান্তরের বিষয়টি আটকে আছে। প্রকল্পের জনবলও বিদায় দেওয়া যাচ্ছে না।’

সাম্প্রতিক বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত

জানা যায়, গত ৩ অক্টোবর এ বিষয়ে এক বৈঠকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিএমটিএফ এবং প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বিএমটিএফে রক্ষিত ইভিএমগুলোর বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশনের একটি টিম সরেজমিনে যাবে এবং পর্যবেক্ষণের সময় আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। সুষ্ঠুভাবে হস্তান্তরের লক্ষ্যে ক্রয় করা সব মালপত্র, যেমন—সব সফটওয়্যারের স্বত্ব, সোর্স কোডসহ ইভিএম, সব সফটওয়্যারের সোর্স কোড, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন বুঝে নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আপডেট সফটওয়্যার ইভিএমে ইনস্টল করে দেখাতে হবে। এক্সক্লুসিভ টিমের মাধ্যমে, যারা ইভিএমের সফটওয়্যার তৈরি করেছে, তাদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সচল ও অচল ইভিএমের সঠিক হিসাব বিএমটিএফ এবং মাঠ পর্যায় থেকে সংগ্রহ করতে হবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য টাইমলাইন নির্ধারণ করতে হবে। ইভিএম হস্তান্তরের পর তা পরিচালনার জন্য একটি অধিশাখা সৃজনের প্রয়োজন হবে। ইভিএমের পরিমাণ নির্ধারণ করে তা গ্রহণ করে বিএমটিএফের ওয়্যারহাউসেই রাখতে হবে।

উল্লেখ্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২১ নভেম্বর ইসিকে দেশের সব নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ২৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ইসি সচিবালয়কে বলা হয়, ইভিএম চালুর লক্ষ্যে দ্রুত প্রকল্প প্রস্তাব পেশ করতে হবে। তবে সে সময় ড. এ টি এম শামসুল হুদা এবং পরে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কমিশন প্রস্তাব পেশ করতে পারেনি। ২০১১ সালে প্রকাশিত শামসুল হুদা কমিশনের পঞ্চবার্ষিক কৌশলগত পরিকল্পনায়ও ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টিকে ‘বিপুল শ্রমসাধ্য ও ব্যয়সাপেক্ষ’ বলে মত দিয়ে বলা হয়, ‘প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন কতটা কাজে লাগানো সম্ভব হতে পারে তার সীমা সম্পর্কে সচেতন থাকাও নির্বাচন কমিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখনো অনেক মানুষের আয়ত্তে কম্পিউটার ও কম্পিউটারসংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দক্ষতা নেই।’

তবে এর আগে থেকেই বুয়েটের তৈরি কম দামের ইভিএম ব্যবহার শুরু করে নির্বাচন কমিশন এবং ওই ইভিএম ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে তার ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। তথ্য কমিশনকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, ড. শামসুল হুদা কমিশন প্রথম পর্যায়ে বুয়েট থেকে ১৩০টি ইভিএম সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো উন্নত ৪০০ ইভিএম সংগ্রহ করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে বিএমটিএফ থেকে সংগ্রহ করা হয় ৭০০ ইভিএম। তবে এই ইভিএম বাতিল করে নিজেদের বিদায়বেলায় কাজী রকিব কমিশন বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে ভোটার শনাক্তের ব্যবস্থাসহ নতুন ইভিএমের বিষয়ে উদ্যোগী হয়। ২০১৬ সালের ২৫ জুলাই নির্বাচন কমিশনের কাছে এই নতুন ইভিএম প্রটোটাইপ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন সে সময়ের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক। ওই নতুন ইভিএমই পরে কেনা হয়।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে নতুন ইভিএম ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কে এম নুরুল হুদা। প্রাথমিকভাবে ৮০ হাজার ইভিএম কেনে ইসি। ওই সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুধীসমাজ ইভিএমের বিরোধিতা করলেও পিছু হটেনি কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। এ জন্য নেওয়া হয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। সিদ্ধান্ত হয় দুই লাখ ২০ হাজার ইভিএম কেনার। সে সময় কমিশনের পরিকল্পনা ছিল দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের। ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ধাপে ধাপে মোট এক লাখ ৫০ হাজার ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে কেনা হয়। প্রতিটি মেশিনের পেছনে ব্যয় হয় দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো, যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র বিরোধিতার মুখে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এত দামি মেশিন কোথায় রাখা হবে, তার জন্য প্রকল্পে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ব্যবহারের জন্য আরো দুই লাখ ইভিএম কেনার পরিকল্পনা নেয় কে এম নুরুল হুদা কমিশন। ‘নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রস্তাবিত প্রকল্পে ছয় হাজার ৬৬০ কোটি ২৯ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় সরকার ওই প্রকল্প নিয়ে আপাতত না এগোনোর সিদ্ধান্ত নেয়। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি স্থগিতের আগে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ইভিএম পরীক্ষা এবং এর ব্যবহারের পক্ষে মতামত প্রচার করে।

এই ইভিএমে ফলাফল পরিবর্তন সম্ভব

২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে ভোডাফোন নেদারল্যান্ডসের সিনিয়র সলিউশন আর্কিটেক্ট ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন যে ইভিএম ব্যবহার করছে তাতে ইন্টিগ্রেটেড ও স্বয়ংক্রিয় রেজাল্ট তৈরির সুযোগ নেই, বরং এতে হাতে ফলাফল তৈরি হয়। এসডি কার্ড বা অডিট কার্ডের মাধ্যমে কেন্দ্রের বুথ থেকে ফলাফল হস্তান্তরের পরের সব প্রক্রিয়া ম্যানুয়াল। কেন্দ্রের ফলাফল ও পুরো আসনের সব কেন্দ্রের ফলাফল তৈরি হয় ম্যানুয়ালভাবে। মেশিন নষ্ট বা হ্যাং হলে কিংবা ব্যাকআপ রাখার জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে এক্সট্রা কার্ড দেওয়া হয়। অডিট কার্ডের চিপ টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে, আগে থেকেই ধারণ করা প্রি-লোডেড ফলাফলের মাধ্যমে কিংবা অন্য একটি অডিট কার্ডের মাধ্যমে জালিয়াতি সম্ভব। ইভিএমের অন্যান্য সব প্রক্রিয়া ডিজিটালি স্বচ্ছ হলেও শুধু ফলাফল তৈরির ম্যানুয়াল কাজটি অস্বচ্ছ। অডিট কার্ডের মাধ্যমে বুথ ফলাফল হস্তান্তরের পরে ম্যানুয়াল ফলাফল তৈরির কাজ পুরো ইভিএমব্যবস্থাকে শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। লাখো কার্ড নির্বাচনের ঠিক আগে ফরেনসিক করার সক্ষমতা নির্বাচন কমিশন কিংবা রাজনৈতিক দলের নেই। ডিজিটাল অডিট বা ফরেনসিক না করলে ওই কার্ডে আগে থেকেই কোনো ফলাফল কপি করা ছিল কি না, সেটা প্রমাণ করা যায় না।

এ ছাড়া স্বচ্ছ ব্যালট বক্স দেখানোর বাধ্যবাধকতার মতো অডিট কার্ডে আগে থেকেই কোনো ফলাফল রেকর্ড করা আছে কি না, তা চেক করার ব্যবস্থা নেই। ইভিএমে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) নেই। পেপার ব্যাক অডিট ট্রেইল হচ্ছে ভোটের স্লিপ। সেটা ভোট দেওয়ার রিসিপ্ট। এর মাধ্যমে ভোটার নিশ্চিত হন, তিনি কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। এই রিসিপ্ট ভোটের পরে ভোটার নিজে স্বচ্ছ ব্যালট বক্সে ফেলবেন, নিয়ে যাবেন না। জালিয়াতির অভিযোগ থাকলে, এই স্লিপ গুনে পুনরায় ভোট গণনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন যে ইভিএম ব্যবহার করতে যাচ্ছে তাতে তা নেই।

২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর রংপুরে সিটি নির্বাচন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ইভিএম সম্পর্কে বলেন, ‘এটি একটি দুর্বল যন্ত্র। শক্ত করে বলতে হলে এটি একটি জালিয়াতির যন্ত্র। এই যন্ত্র দিয়ে নির্বাচন কমিশন যে ফলাফল চায়, সেই ফলাফল সৃষ্টি করতে পারবে। এটা যাচাই-বাছাই করে দেখার সুযোগ হবে না।

 

সূত্র: কালের কণ্ঠ

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..

© All rights reserved © 2009-2022 bddhaka.com  # গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ের বিধি মোতাবেক নিবন্ধনের জন্য আবেদিত # এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Theme Developed BY ThemesBazar.Com