এক বুক কষ্ট নিয়ে সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন বাংলাদেশ দলের এক সময়ের নির্ভরযোগ্য ওপেনার শাহরিয়ার নাফীস। গত আট বছর ধরে জাতীয় দলে ফেরা প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন এ সাবেক ওপেনার। ২০১৩ সালের জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে ভালো পারফর্ম করায় বাদ পড়েন তিনি। এরপর আর সুযোগ পাননি জাতীয় দলে।
শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টায় হোম অব ক্রিকেটে সংবাদ সম্মেলন কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরের ঘোষণা দেন নাফীস। ইতি টানেন ১৬ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের। স্বামীর এমন বিদায়ী মুহূর্তে আবেগী হয়ে পড়লেন স্ত্রী ইশিতা নাফীস। ক্রিকেটারদের জীবনে টাকার অভাব হয় না, কিন্তু একটা সময় তারা কতোটা সংগ্রাম করেছেন, সেই স্মৃতিও সবার সঙ্গে শেয়ার করলেন নাফীসের সহধর্মিনী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শুক্রবার (১২ ফেব্রুয়ারি) এক বিশাল স্ট্যাটাসে তিনি জানিয়েছেন অনেক অজানা কথা। পূর্বপশ্চিম পাঠকদের জন্য ইশিতার সেই স্ট্যাটাস হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘অনেকবার আমি মানুষকে বলতে শুনেছি, ক্রিকেটারদের স্ত্রীরা গোল্ড ডিগার (সম্পদ ও টাকা পয়সার লোভে যে নারী পুরুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে) হয়। এটা সত্য, বিলাসবহুল গাড়ি, অনেক জুয়েলারি এবং কাপড়-চোপড়, নিয়মিত নামি রেস্টুরেন্টে খাওয়া-একজন ক্রিকেটারের সঙ্গে বিয়ে হলে এই সবকিছুই একসঙ্গে পাওয়া যায়, বিশেষ করে তিনি যদি হন জাতীয় দলের ক্রিকেটার।
কিন্তু সম্ভবত এই সব উপহারের প্যাকেজ ছাড়াও আরও কিছু জিনিসও পাওয়া যায়। ২০০৬ সালের কথা, যখন আমি শাহরিয়ার নাফীসকে বিয়ে করি। সে ছিল ওপেনিং ব্যাটসম্যান এবং বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সহঅধিনায়ক। বাংলাদেশ জাতীয় দলের উদীয়মান তারকা এবং বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড় ছিল সে। আমাদের যাত্রাটা সুইজারল্যান্ডে ধারণ করা জশ রাজের ফিল্মের চেয়ে কম স্বপ্নীল ছিল না।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এর ভেতরে ভিন্ন কিছু অভিজ্ঞতাও হয়েছে। বিয়ের ৬-৭ মাসের মাথায় আমার স্বামী কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে ছিটকে পড়ে। বেতন ছিল না, ছিল না বিপিএল এবং ডিপিএলেও ওই সময় ভালো কিছু ছিল না। আমরা জানতাম না কি করে সব কিছু সামলাব। তার সঙ্গে ছিল আমার পড়াশোনা, তার পড়াশোনা এবং আমাদের জন্ম নেয়া প্রথম সন্তানের খরচ। তবে আমার বাবা-মাকে ধন্যবাদ দিতে হবে, যারা সবসময় আমাদের পাশে ছিলেন। কোনো ব্যাপারেই তারা আমাদের ছেড়ে দেননি এবং ভেঙে পড়তে দেননি।
বিয়ের ১৪ বছর পার হওয়ার পর আমি এখন একজন আইনজীবী, একজন শিক্ষিকা, তার সন্তানদের মা এবং সেই মানুষটি যে কিনা তার উত্থান-পতনে সবসময় পাশে ছিল। আমি প্রতিটি দিন তার পাশে ছিলাম, যেদিন সে সেঞ্চুরি করে বাসায় ফিরতো কিংবা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে।
মাঝেমধ্যে মানুষ তার অর্জনের পুরো কৃতিত্ব আমাকে দিয়েছে, মাঝেমধ্যে তারা তার ব্যর্থতার জন্যও আমাকে দায়ী করেছে। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, কপালে যা আছে তা আমরা পাবই। আমি তাকে মনমরা দেখেছি, কিন্তু ভেঙে পড়তে নয়। ভালো দিন এবং ইতিবাচকতার আশা কখনও হারায়নি।
আমি সবসময়ই তাকে টিম বাংলাদেশ এবং তার সতীর্থদের জন্য হাততালি দিতে দেখেছি। এমনকি যখন সে দলের অংশ ছিল না তখনও। সে সত্যিকারের সততা, উদার মানসিকতা এবং সত্যবাদিতায় পরিপূর্ণ একজন মানুষ। এটাই শাহরিয়ার নাফীস। আমি আমার স্বামীকে নিয়ে গর্বিত, তার যাত্রাপথের অংশীদার হতে পেরে গর্ববোধ করি। সে কতটা সফল হয়েছে সেটা ব্যাপার নয়।
এই যুগটা কাল (শনিবার) শেষ হয়ে যাচ্ছে। জীবনের নতুন শুরু অপেক্ষা করছে তার জন্য। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি তার পথচলা যেন মসৃণ এবং সহজ করে দেন। সেইসঙ্গে দোয়া করি, তার নাম যেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকে।’