অনলাইন নিউজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার করার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও কোভিড-১৯ মহামারির কারণে খাদ্য, বিদ্যুৎ ও আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সু-সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে ৪টি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন যার জন্য দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের যুদ্ধ এমন এক সময়ে এসেছে যখন বিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারি থেকে উদ্ধার পেতে লড়াই করে চলেছে। এ যুদ্ধ ইতিমধ্যে নাজুক বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুতর চাপ যুক্ত করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে যুক্ত হয়ে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে শুক্রবার অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ (জিসিআরজি) এর প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে দেয়া ভাষণে এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা কার্যকরভাবে সংকট মোকাবিলায় উন্নত অর্থনীতি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর ভূমিকা কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বর্তমান পরিস্থিতিকে অত্যন্ত অস্থিতিশীল করে তুলেছে, যেখানে খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্যের স্বল্প সরবরাহ এবং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই সাধারণ মানুষের জীবনে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে।
তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ এবং এসআইডিগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তাদের অবিলম্বে এবং লক্ষ্যমাত্রা ভিত্তিক সহায়তা ব্যবস্থার প্রয়োজন।
এ বিষয়ে তিনি উন্নত দেশসমূহ ও বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার এবং আরও সহজলভ্য অর্থায়নের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট চলমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে এই গ্রুপটি গঠন করেছেন।
বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য চারটি প্রস্তাব রেখেছেন।
প্রথম প্রস্তাবে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার করতে হবে এবং একটি সু-সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। জি-৭, জি-২০, ওইসিডি, এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।’
তিনি বলেন, এই গ্রুপের স্টিয়ারিং কমিটি সব বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠন করায় তিনি খুশি।
তিনি বলেন, আমরা সংকট মোকাবিলায় কার্যকর সুপারিশ প্রণয়নের জন্য তাদের প্রচেষ্টায় আমাদের পূর্ণ সমর্থন দেব।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত, অবিলম্বে বিশ্বব্যাপী লজিস্টিক এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধাগুলো মোকাবিলা করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, এ প্রয়াস পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশ ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির বৈশ্বিক বাণিজ্য ও রপ্তানি আয় পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সমর্থনও থাকতে হবে।
তিনি বলেন, উন্নত অর্থনীতি এবং বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং শুল্ক-মুক্ত-কোটা-মুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার এবং আরও সহজলভ্য অর্থায়ন প্রদান করতে হবে।
তৃতীয় প্রস্তাবে, তিনি বলেন, কার্যকর খাদ্য সঞ্চয় ও বিতরণ ব্যবস্থার জন্য কৃষি খাতের জন্য প্রযুক্তি সহায়তা এবং বিনিয়োগের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব প্রদান করা অপরিহার্য।
তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ¦ালানি ক্ষেত্রে বিশেষ করে এলডিসিতে অনেক সম্ভাব্য ব্যবসার সুযোগ রয়েছে।
তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন, ‘এই এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে আমরা বিদ্যমান উত্তর-দক্ষিণ, দক্ষিণ-দক্ষিণ এবং ট্রায়াঙ্গুলার সহযোগিতার সুবিধা নিতে পারি। এই বিষয়ে বেসরকারি খাতের সাথে সম্পৃক্ততাও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে।’
পরিশেষে, তিনি ৪৮-সদস্যের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ফোরামের সভাপতি হিসেবে উল্লেখ করেন, আমরা অনেক এসআইডি এবং নি¤œাঞ্চলীয় জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
তিনি বলেন, ‘এসব দেশে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থা গুরুতর চাপের মধ্যে রয়েছে।
বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় দৃঢ় বিশ্বাসী।
তিনি বলেন ‘আমরা সর্বদা বিশ্ব শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। এই গোষ্ঠীকে সমর্থন করার জন্য আমাদের প্রতিশ্রুতি সেই প্রত্যয় থেকে উদ্ভূত।’
জাতি হিসাবে আমরা সবচেয়ে ভয়ংকর চ্যালেঞ্জগুলোর বিরুদ্ধে সহিষ্ণুতার জন্য পরিচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি তার সর্বশেষ উদাহরণ।
তিনি বলেন, মহামারি কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে আমাদের প্রচেষ্টায় জীবন ও জীবিকার সুরক্ষার মধ্যে সতর্ক ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রচেষ্টায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার প্রদান করেছি। যারা সবচেয়ে পেছনে রয়েছে তাদের সহায়তা দেয়ার আমরা সামাজিক সুরক্ষার কভারেজ প্রসারিত করেছি।
তিনি উল্লেখ করেন, ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ আমাদের একটি বড় স্বাস্থ্য সংকট এড়াতে এবং জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের রপ্তানি খাত এবং এসএমইকে সমর্থন করার জন্য বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিয়েছি। ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা হয়েছে। আর এই পদক্ষেপগুলি আমাদের গত অর্থবছরে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনে সহায়তা করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
গ্লোবাল সাউথের প্রতিনিধি হিসাবে তিনি বলেন, ‘আমি এই সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষের কণ্ঠস্বর টেবিলে নিয়ে এসেছি।’
তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় উন্নয়ন যাত্রা অনেক উদ্ভাবনী জলবায়ু কর্মের নেতৃত্ব দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা অন্যদের সুবিধার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন, জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং পরিবেশগত অবনতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের জ্ঞান, বোঝাপড়া এবং অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই।
কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের পদক্ষেপ সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিব জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, মহামারি থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁর সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
তিনি বলেন, এই পদক্ষেপগুলির মধ্যে রয়েছে সামাজিক-নিরাপত্তা-নেট কর্মসূচির প্রসার এবং নিয়মিতভাবে ১ কোটিরও বেশি মানুষের কাছে খাদ্য ও নগদ অর্থ সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, কার্ড ইস্যু করার মাধ্যমে ১ কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে (৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য কমিয়ে) ভোজ্যতেল, ডাল এবং চিনির মতো ভোগ্যপণ্য বিক্রি করার কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া , তিনি বলেন, তাঁর সরকার একাধিক উৎস অনুসন্ধান করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশীয় খাদ্য সংগ্রহ অভিযান জোরদার করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের মধ্যে সার বিতরণ করেছে এবং ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।।
তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি ফরেন রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে তারা বিলাসবহুল দ্রব্যাদি আমদানিতে নিরুৎসাহিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার যথাযথ চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্সের জন্য ২.৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে।