অনলাইন নিউজ : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে প্রায় অর্ধকোটি লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। যদিও সরকারিভাবে নগদ টাকা, চাল, শুকনা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। বানভাসি মানুষদের নেওয়া হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু এসব উদ্যোগ-সহায়তা পরিস্থিতির ভয়াবহতার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
বন্যায় সিলেটের ৬০ শতাংশ প্লাবিত হয়েছে। আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ। এ জেলার ৮০-৯০ শতাংশ পানিতে ডুবে গেছে। দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে এ পর্যন্ত ১২ জেলার ৬৪ উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১২২ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে এবারের বন্যা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সেনাবাহিনী, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সসহ স্থানীয় প্রশাসন উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছে। সেনাবাহিনীর ৩২টি, নৌবাহিনীর ১২টি, ফায়ার সার্ভিসের ৮টিসহ মোট ৫২টি বোট উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে। সুনামগঞ্জে ৭৫ হাজার এবং সিলেটের ৩০ হাজার মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। একই সঙ্গে বন্যাদুর্গত এলাকায় শুকনো ও অন্যান্য খাবার ছাড়াও নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়ভাবে চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট এবং রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হলেও তাতে বানভাসি মানুষের স্থানসংকুলান হচ্ছে না। আবার পানির হাত থেকে বাঁচলেও দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সুনামগঞ্জে অবনতি হয়েছে। এ ছাড়া নতুন করে নীলফামারী, নেত্রকোনা, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ আরও ১২টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। আজ সোমবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত থাকবে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে তীব্র খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট : সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার কারণে আশ্রয়কেন্দ্র, খাদ্য, শুকনা খাবার ও পানির সঙ্কট তীব্র হয়েছে। এ এলাকায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় তাদের মধ্যে ত্রাণ সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকা বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার পর সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। এখানে ২ হাজারের মতো বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার বা পানীয়জলের তীব্র সঙ্কট। পানীয় জলের জন্য সিটি করপোরেশনের সামনে একটি পানির ট্যাঙ্ক রাখা হয়েছে। তবে কোমর বা বুকসমান পানি ডিঙিয়ে অনেকে সেখান পর্যন্ত যেতে পারছে না। মজুদ নেই কোনো চাল।
এ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের ৪৯৭টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ জন আশ্রয় নিয়েছে। গবাদিপশু রয়েছে ৩১ হাজার। আমরা ৪টি পানি বিশুদ্ধকরণ পাওয়ার প্ল্যান্ট বসিয়েছি। সেখান থেকে বোতলজাত করে বানভাসি মানুষের কাছে পানি পৌঁছে দিচ্ছি। মেডিকেল টিম রয়েছে ১৪০টি। এ পর্যন্ত ৬১২.৪২০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে কোনো চাল মজুদ নেই। শুকনা খাবার রয়েছে ৮১১৮ প্যাকেট। নগদ টাকা রয়েছে ৯২ লাখ। বিতরণ করা হয়েছে ২ লাখ টাকার শুকনা খাবার। তবে পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে আশ্রয়কেন্দ্র, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট তীব্র হতে পারে।
হাওরাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি আগ্রাসী রূপ নিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত। অনেকের ঘরবাড়ি পানির নিচে। কোথাও কোথাও মানুষ ঘরের চালে, উঁচু কোনো স্থানে, বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে ও স্কুল-কলেজের উঁচু দালানে গরু-ছাগল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। খাবার পানির সঙ্কট তো আছেই। এ ছাড়া কোনো কোনো জায়গায় মানুষ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, বন্যাকবলিত মানুষকে যে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে তা একেবারেই অপ্রতুল। ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে লোকজন। কিন্তু কেউই ত্রাণ নিয়ে আসছে না। বসতঘরে পানি থাকায় চুলায় আগুন জ্বালানোর মতো পরিস্থিতি নেই। শিশু খাদ্যেরও তীব্র সঙ্কট রয়েছে।
ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনতাসির হাসান বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে খিচুড়ি বিতরণ করছি। শুকনো খাবারের জন্য প্যাকেট প্রস্তুত করা হচ্ছে।
নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি : নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। ভারী বর্ষণে জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এরই মধ্যে কলমাকান্দা উপজেলার প্রায় ৯২ শতাংশ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা শহরের সঙ্গে কমলাকান্দা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বেগম অঞ্জনা খান মজলিশ গণমাধ্যমকে বলেন, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ খাদ্য, নগদ টাকা ও শুকনো খাবার রয়েছে, তা দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব। তবে এর স্থায়িত্ব বাড়লে আমরা আশ্রয়কেন্দ্র, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে পড়ব। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫৭০ জন। এখন আমাদের খাদ্য মজুদ রয়েছে ৬৯ মেট্রিক টন চাল, নগদ টাকা ২ লাখ ৫০ হাজার ও শুকনা খাবারের প্যাকেট রয়েছে ১ হাজার ১৫টি। এ পর্যন্ত ৪৫২৭ জন পুরুষ, মহিলা ৪৪২২০ জন, শিশু ১৬০৮৮ জন ও ৭০৬৩ জন প্রতিবন্ধীকে ৩২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীতে পানি বাড়ছে : কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৯ উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের প্রায় ১৫০টি গ্রামের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৬০টি বাড়ি। সেই সঙ্গে বানভাসি এলাকায় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, গোখাদ্য ও জ্বালনির তীব্র সঙ্কট।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম গণমাধ্যমকেবলেন, কুড়িগ্রামে দুই দিন ধরে বৃষ্টি নেই। তবে উজান থেকে যে পানি আসছে সেটাই আশঙ্কা। এখন পর্যন্ত যারা পানিবন্দি রয়েছে, তারা বাড়িতেই রয়েছে। আমাদের ২৬১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। চাল মজুদ রয়েছে ২৯৫ মেট্রিক টন। নগদ টাকা রয়েছে ১৪ লাখ ৫০ হাজার। শিশুখাদ্য কেনার জন্য নগদ টাকা রয়েছে ১৮ লাখ ৯৫ হাজার। গবাদিপশুর জন্য ১৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা রয়েছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রায় ৪ হাজার মানুষ পানিবন্দি। এখানে শুধু ১টি আশ্রয়কেন্দ্র। সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো শুকনো খাবার, চাল বা বিশুদ্ধ পানি পাঠানো হয়নি। আজ সোমবার চাল দেওয়া কথা রয়েছে।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান : হবিগঞ্জের চারটি উপজেলার নদীগুলোর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে হাওরের নিম্নাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে বন্যাকবলিত হয়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় ২১টি, নবীগঞ্জে ১৩টি, লাখাইয়ে ১৫টি ও বানিয়াচংয়ে ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান গণমাধ্যমকে বলেন, আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলায় পানি ওঠার পর দুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে শুকনো খাবার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। খাবারের প্রয়োজনে ৩৩৩ হটলাইনে ফোন করলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাবার পৌঁছে দেওয়া হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, পানি নামতে শুরু করায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় বন্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। শুক্রবার দুপুর থেকে হাউড়া বাঁধ ভেঙে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী ১২ গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ১৮২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ৩০টি পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি ১৫৪টি পরিবারকে রোববার ২০ কেজি করে চাল ও ত্রাণের বক্স দেওয়া হয়েছে। তাদের চিকিৎসার জন্য ১০০টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
এ জাতীয় আরো খবর..