বিডি ঢাকা ডেস্ক
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে অভিনবভাবে বৈদ্যুতিক মাধ্যমে ছবি আদান-প্রদানের একটি প্রক্রিয়া দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন মে এবং স্মিথ নামের দুজন বিজ্ঞানী। এরই সূত্র ধরে প্রায় ৪০ বছর পর ১৯২৬ সালে যুক্তরাজ্যের জন লগি বেয়ার্ড প্রথমবারের মতো সাদা আর কালো রং সংবলিত ছবি বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে এক স্থান হতে অন্য স্থানে প্রেরণে সক্ষম হন।
এ অভাবনীয় উদ্ভাবন বিশ্বের বুকে ‘টেলিভিশন’ নামের এক অদ্ভূত যন্ত্রের অগ্রযাত্রার গোড়াপত্তন করে। এক দশক পর রাশিয়ান প্রকৌশলী আইজ্যাক শোয়েনবার্গ অক্লান্ত পরিশ্রম করে পৃথিবীর প্রথম টেলিভিশন চ্যানেল হিসেবে বিবিসির স¤প্রচারের সূত্রপাত ঘটান।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪০ সালে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও বিপণন শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই সংবাদপত্রের সঙ্গে সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমের ভ‚মিকায় আবর্তিত হয় টেলিভিশন। শুধু তাই নয়, কালক্রমে এটি হয়ে ওঠে একটি অন্যতম প্রধান গণমাধ্যম।
শুরুর দিকে টেলিভিশন ভারী বাক্সের আকারে হলেও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে সঙ্গে এটি হালকা এবং সহজে বহনযোগ্য হয়ে গেছে। যেখানে আজ থেকে তিন কিংবা চার দশক আগেও মানুষকে টেলিভিশন ব্যবহারের জন্য পৃথক টেবিল বা ওয়ার্ডরোব কিনতে হতো, সেখানে টেলিভিশন এখন ‘স্মার্ট টিভি’ নামাঙ্কিত হয়ে অত্যাধুনিকভাবে অগণিত বাসাবাড়ির দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে।
আর বুঁদ করে রাখছে মানুষকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক টকশো থেকে শুরু করে বিতর্ক, বিনোদন, ক্রীড়া ও গোটা বিশ্বের চলতি ঘটনাপ্রবাহের বিস্তারিত সংবলিত অনুষ্ঠানমালা দিয়ে। নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেটের আবিষ্কারও টেলিভিশনের আবেদনকে এতটুকু নিম্নমুখী করতে পারেনি, বিশেষত আমাদের বাংলাদেশে। বরঞ্চ, টেলিভিশনের চাহিদা তখন উত্তরোত্তর বেড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) অনন্য অনুষ্ঠানমালা স¤প্রচারের ফলে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অভিষেক এই চাহিদাকে প্রবর্ধিত করে আরও কয়েক ধাপ।
তবে গত দেড় যুগ ধরে ইন্টারনেট ধীরে ধীরে সহজলভ্য হয়ে ওঠায় এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মানসম্মত অনুষ্ঠান ও কনটেন্ট তৈরির বদলে সস্তা চলচ্চিত্র কিংবা মানহীন অনুষ্ঠান প্রযোজনা করে স্বল্প পরিশ্রম আর কম অর্থ ব্যয়ে অধিক টিআরপি লাভের কৌশলের দিকে ঝুঁকে পড়ায় মানুষ টেলিভিশনের ওপর ক্রমশ আগ্রহ হারাচ্ছে। মূলত, ‘টিআরপি’ বলতে বোঝায় টেলিভিশন রেটিং পয়েন্টকে।
এটি এমন এক ধরনের নির্দেশক, যার দ্বারা বিশেষ প্রক্রিয়ায় কোনো একটি টেলিভিশন কতটা দর্শকপ্রিয় তা পরিমাপ করে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিজ্ঞাপন দর নির্ধারণ করা হয়। যে টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা যে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের টিআরপি যত বেশি, সেই চ্যানেল অথবা ওই অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দরও তত বেশি।
আর বিজ্ঞাপন টিভি চ্যানেলগুলোর একটি প্রধানতম আয়ের উৎস হওয়ায় মিডিয়াগুলো সর্বদাই স্বল্প ব্যয়ে অধিক টিআরপি অর্জনে উদ্যোগী হচ্ছে বর্তমানে। হোক তা সংবাদভিত্তিক চ্যানেল কিংবা মিশ্র ঘরানার মিডিয়া। এতে করে বেশ কয়েক বছর ধরেই নিম্নমানের অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্রের স¤প্রচারে সয়লাব হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের অধিকাংশ টিভি চ্যানেলকে।
ফলে বিটিভিসহ দেশে স¤প্রচারিত হওয়া ৩৬টি টিভি চ্যানেলের হাতেগোনা দুয়েকটি অনুষ্ঠান ব্যতীত কোনো অনুষ্ঠানই আর দর্শকদের সেভাবে বিমোহিত করে রাখতে পারছে না।
অথচ গত শতকের আশি এবং নব্বইয়ের দশকে সম্প্রচারিত হওয়া ‘নক্ষত্রের রাত’ কিংবা ‘কোথাও কেউ নেই’-এর মতো টেলিভিশন নাটকগুলোও বাংলাদেশি দর্শকদের উন্মাদিত করতো তুমুলভাবে। কেননা তখনকার মিডিয়ার কর্তাব্যক্তিরা টিআরপি অর্জনের চেয়েও মানসম্মত অনুষ্ঠান প্রযোজনার দিকে জোর দিতেন। আর গণমাধ্যমকর্মীরাও ভালো কাজ করতে উদগ্রীব থাকতেন সবসময়।
কারণ, তাদের বিশ্বাস ছিল ভালো কাজ করলে এমনিতেই টিআরপি বাড়বে বা উচ্চ দরের বিজ্ঞাপন পাওয়া যাবে। তবে বর্তমানের মিডিয়া মালিক কিংবা মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সেই প্রবণতা আর লক্ষ করা যায় না। তাঁরা সকলেই স্বল্প ব্যয় এবং পরিশ্রমের বিনিময়ে অধিক মুনাফা অর্জনের পক্ষপাতী। তারা অনন্য কোনো কিছু সৃষ্টির ধার ধারেন না।
চলতি বছরের মে মাসে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন-এ প্রকাশিত ‘টিআরপি নির্ধারণ শুরু হবে কবে?’ শীর্ষক এক নিবন্ধে গণমাধ্যমকর্মী বিপ্লব কুমার পাল তাঁকে দেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের বিপণন শাখার প্রধান এ প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন তা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বিপ্লবকে বলেছিলেন, বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে উচ্চ মানের অনুষ্ঠান তৈরি করে যে টাকার বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়, সেই একই পরিমাণ অর্থ পাওয়া যায় মাত্র ৫-১০ হাজার টাকায় চল”িচত্র কিনে প্রচার করে।
তাই বাজেট ও প্রণোদনার স্বল্পতা থাকায় এবং অধিক লভ্যাংশ আয়ের লক্ষ্যে কিছু কিছু টিভি চ্যানেল এখন আর আগের মতো নিজস্ব অনুষ্ঠান নির্মাণ করছে না। এর বিপরীতে, তাঁরা দিনে ২/৩টি সাশ্রয়ী অঙ্কে ক্রয় করা চলচ্চিত্র দেখাচ্ছে। এতে করে যেমন একদিকে অনন্য অনুষ্ঠান নির্মাণে কোনো ব্যয় হচ্ছে না, তেমনই নামমাত্র টাকা খরচ করে অধিক মুনাফা অর্জন করা যাচ্ছে।
আবার, ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ফলে একই প্রবণতা এখন দৃশ্যমান টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটগুলোতে কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রেও। গুটিকয়েক মিডিয়া ছাড়া প্রায় সকল গণমাধ্যমই যেনতেনভাবে অহরহ নিম্নমানের কনটেন্ট তৈরি করছে শুধু ভাইরাল হতে এবং ওয়াচ টাইম বৃদ্ধির জন্য। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গণমাধ্যমগুলোর সংশ্লিষ্ট মনিটাইজড পেইজে নির্দিষ্ট সংখ্যক অনুসারী ও ওয়াচটাইম থাকলেও এখন মিলছে অর্থ উপার্জনের সুযোগ।
সা¤প্রতিক সময়ের এক জরিপ মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ২০২০ সাল নাগাদ টেলিভিশন শিল্পের ব্যাপ্তি ছিল প্রায় সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আগামী বছর বেড়ে ৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অপর এক গবেষণা বলছে, গোটা দেশে বিক্রি হওয়া সকল ইলেকট্রনিকস পণ্যের মধ্যে এখনও সর্বোচ্চ টেলিভিশন (৩০.০৩%)। এ থেকে বোঝা যায়, আধুনিক ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের যুগে বাংলাদেশিরা এখনও টেলিভিশন থেকে একেবারে বিমুখ হয়ে যায়নি।
তাই বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল তথা মিডিয়াগুলো যদি শুধু টিআরপি কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওয়াচটাইমমুখী না হয়ে মানসম্মত স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান ও কনটেন্ট তৈরিতে উদ্যোগী হয়, তবে গণমানুষ যেভাবে এখনও মিডিয়ামুখী হয়ে রয়েছেন তা অব্যাহত থাকবে। রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি বা প্রণোদনাও এ খাতের মানোন্নয়নে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর