বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:২৭ অপরাহ্ন

অসচ্ছল পরিবারের তরুণী ও মধ্যবয়সী নারীরাই টার্গেট,কয়েক বছরে বিদেশে সহস্রাধিক পাচার

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১
  • ২৮৯ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ : বাংলাদেশ থেকে বিগত কয়েক বছরে সহ¯্রাধিক নারী পাচার হয়েছে বিদেশে। দেশের আট জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার হচ্ছে নারী। পাচারকারীরা বেছে নিয়েছে নারী পাচারের সাতটি রুট। ভারত, ওমান, দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, কুয়েত, মিসর ও জর্ডানে পাচার হচ্ছে নারী। দেশের যে ৮ জেলার সীমান্ত দিয়ে মানব পাচার করা হচ্ছে তার মধ্যে আছে চুয়াডাঙ্গার নেপা, সাতক্ষীরার দেবহাটা, যশোরের বেনাপোল, লালমনিরহাটের দহগ্রাম, জয়পুরহাটের বস্তাবর, মৌলভীবাজারের পশ্চিম শিলুয়া, টেকনাফের জালিয়াপাড়া এবং কুমিল্লার গৌরাবাড়ী। কখনও সখ্য গড়ে, কখনও ড্যান্স ক্লাবের আড়ালে নারীদের পাচার করছে নারী পাচারকারী চক্র। নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত পাচারকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে নারী পাচার করার নেপথ্যের চাঞ্চল্যকর কাহিনী বের হয়ে এসেছে। র‌্যাব ও সিআইডি সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে নারী পাচারকালে গত শুক্রবার রাতের অভিযানে ২৩ জনকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব। বিদেশে চাকরিসহ নানা প্রলোভনে তাদের পাচার করা হচ্ছিল। তাদের মধ্যে ঢাকা থেকে উদ্ধার করা ২২ নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে ও চুয়াডাঙ্গা থেকে উদ্ধার করা এক নারীকে ভারতে পাচার করা হচ্ছিল। ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গায় পৃথক অভিযান চালিয়ে দুটি মানব পাচার চক্রের প্রধানসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করার কথা জানিয়েছে র‌্যাব। তাদের মধ্যে চারজন ভারতে এবং সাতজন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মানব পাচারে জড়িত চক্রের সদস্য। তেজগাঁও ও উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয় মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচার চক্রের অন্যতম হোতা নুর-নবী ভূঁইয়াসহ (৪৪) ৭ জনকে। অন্যরা হলো আবুল বাশার (৫২), আল ইমরান (৪১), মনিরুজ্জামান (৩৫), শহিদ সিকদার (৫৪), প্রমোদ চন্দ্র দাস (৬২) ও টোকন (৪৫)। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও চুয়াডাঙ্গা থেকে গ্রেফতার করা হয় ভারতে পাচারকারী চক্রের চার সদস্যকে। তারা হলেন চক্রটির প্রধান কামরুল ইসলাম ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল (৩৭), তার সহযোগী রিপন মোল্লা (২২), আসাদুজ্জামান সেলিম (৪০) ও নাইমুর রহমান (২৫)। এসব অভিযানে ৫৩টি পাসপোর্ট, ২০টি মুঠোফোন, ৮ বোতল বিদেশী মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার, দুটি মোটরসাইকেল, একটি ল্যাপটপ ও একটি কম্পিউটার জব্দ করা হয়।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, নারী পাচারকারী চক্রের ১০ থেকে ১২ জন সদস্য দেশে সক্রিয়। পাচ বছরের বেশি সময় ধরে গৃহকর্মী, নার্স, রেস্তরাঁকর্মীসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োগ দেয়ার নাম করে নারীদের পাচার করে আসছে চক্রটি। তারা মূলত ভুক্তভোগী নারীদের মধ্যপ্রাচ্যে পাচারের পর বিক্রি করে দিত। চক্রটি ৩০-৩৫ জন নারীকে পাচার করেছে। ঢাকায় এই চক্র কয়েকটি ‘সেফ হাউস’ পরিচালনা করছিল।

র‌্যাবের তদন্তে জানা গেছে, নারী পাচারকারীরা কয়েক ধাপে বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার করছে। তাদের নিশানায় আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের তরুণী ও মধ্যবয়স্ক নারীরা রয়েছেন। চক্রের সদস্যরা প্রথমে তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে ও পরে বিদেশে বিভিন্ন লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখায়। পাচারকারী চক্রের প্রধান নূর-নবী ভূঁইয়া। নূর-নবী ল²ীপুরের স্থানীয় একটি কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৯৬ সালে ঢাকায় এসে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ১৯৯৮ সাল থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে প্রবাসী কর্মী হিসেবে কাজ করেন। ওমানে থাকা অবস্থায় পাচারকারী একটি চক্রের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে মানব পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন তিনি।

র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে, ভারতে নারী পাচারকারী চক্রের সদস্যদের অন্যতম হোতা কামরুল ইসলাম। চক্রের সদস্য ১৫ থেকে ২০ জন। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি অল্পবয়সী নারীদের ভারতে পাচার করে আসছে। চক্রটি নাচ শেখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নারীদের ঢাকায় নিয়ে আসত। পরে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করত। এভাবে ভারতে শতাধিক নারীকে পাচার করেছে চক্রটি। কামরুল ইসলাম ২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে এসে ঢাকার বাড্ডা এলাকায় রিক্সা চালাত। পরে একটি পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ভ্যানচালক হিসেবে কাজ করে। ২০১৬ সালে চলচ্চিত্র অঙ্গনের ব্যক্তিদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ২০১৯ সালে হাতিরঝিল এলাকায় ‘ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম’ নামে ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এই ক্লাবে নাচ শেখানো ও পরে ভারতে ভাল বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে নারীদের পাচার করা হতো।

র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করত চক্রটি। দেশী-বিদেশীসহ প্রায় ৫০ জন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রæপ খুলে বিভিন্ন বয়সের নারী ও তরুণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। এই গ্রæপের তরুণীদের মডেল বানানো ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করত। পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী দেশের বিভিন্ন সুপারমল, সুপারশপ ও বিউটি পার্লারে চাকরি দেয়ার কথা বলে তরুণী ও নারীদের বস রাফির সহযোগিতায় বিদেশে পাচার করত। পার্শ্ববর্তী দেশে তাদের পাচারের পর প্রথমে একটি সেফ হাউসে নেয়া হতো। সেফ হাউসে তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এবং জোর করে মাদক সেবন করতে বাধ্য করত তারা। মাদক সেবনের পর তাদের জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন করে এসব ঘটনার ভিডিও ধারণ করা হতো। যাতে তাদের পরবর্তীতে বø্যাকমেল করা যায়। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভিকটিমদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। তারা কয়েকটি ধাপে পাচারের কাজটি সম্পন্ন করতো।

সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, চাকরির প্রলোভনে সহ¯্রাধিক তরুণীকে দুবাইয়ে পাচার করে যৌনকর্মে বাধ্য করেছেন আজম খান (৪৫) ও তার সহযোগীরা। তরুণীরা তার কথামতো না চললে তাদের ওপর নেমে আসত নির্যাতনের খড়গ। টর্চারসেলে আটকে রেখে দিনের পর দিন মারধর ও বৈদ্যুতিক শক দেয়া হতো। চট্টগ্রামের বাসিন্দা আজম খানের দুবাইয়ে হোটেলের আড়ালে যৌন ব্যবসাই প্রধান। দেশে তার রয়েছে অর্ধশতাধিক দালাল। দুবাইয়ে তিনটি ফোরস্টার ও একটি থ্রিস্টার হোটেলের মালিক এই আজম খান। হোটেলে বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভনে দালালরা ২০ থেকে ২২ বছর বয়সী মেয়েদের দুবাইয়ে পাচার করত। এসব অভিযোগেই আজম খান ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেফতার অপর দু’জন হলেন আলামিন হোসেন ওরফে ডায়মন্ড (৩৪) ও আনোয়ার হোসেন ওরফে ময়না (৩০)। আজম খানের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে। দুবাইয়ে তার সঙ্গে দুই ভাইও যুক্ত আছেন। এ ছাড়া ভারত ও পাকিস্তানের চক্রও যুক্ত রয়েছে তার সঙ্গে। আজমের বিরুদ্ধে দেশে ছয়টি হত্যা মামলাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে। আট বছর ধরে আজম খান নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত। এ সময়ের মধ্যে সহ¯্রাধিক তরুণী তার ফাঁদে পা দিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, আজম খানের মালিকানাধীন হোটেলগুলো হলো- ফরচুন পার্ল হোটেল এ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড, হোটেল রয়েল ফরচুন ও হোটেল সিটি টাওয়ার। সম্প্রতি আজম খানের নারী পাচার ও যৌন ব্যবসার বিষয়ে জেনে যায় দুবাই পুলিশ। তারা বিষয়টি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানায়। একই সঙ্গে তার পাসপোর্ট বাতিল করে দুবাই কর্তৃপক্ষ। এরপর একটি এক্সিট পাস নিয়ে আজম খান দেশে চলে এসে আত্মগোপনে চলে যান। দেশে ফেরার পর তাকে ধরতে অভিযান শুরু করে সিআইডি। গোপনে একটি পাসপোর্ট তৈরি করেন এবং পার্শ্ববর্তী কোন দেশে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার মধ্যেই দুই সহযোগীসহ আজম খানকে গ্রেফতার করে সিআইডি।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..

© All rights reserved © 2009-2022 bddhaka.com  # গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ের বিধি মোতাবেক নিবন্ধনের জন্য আবেদিত # এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Theme Developed BY ThemesBazar.Com