স্টাফ রিপোর্টার ॥ চলমান কঠোর বিধিনিষেধের তৃতীয়দিনে রাস্তায় চলাচলকারী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যা। অলিগলি ও মহল্লায় বের হওয়ার প্রবণতা আরও বেশি। আজ থেকে অলিগলিতে অভিযান চালাবে র্যাব। জরুরী সেবার আওতায় এ্যাম্বুলেন্স, স্বল্পসংখ্যক প্রাইভেট পরিবহন, পিকআপ ও রিক্সা চলাচল করতে দেখা গেছে। গণপরিবহন না থাকলেও রিক্সা-ভ্যানে যাতায়াত করছে অনেকে। আবার অনেককেই মাস্ক ছাড়া বের হতে দেখা গেছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব পুলিশ ও আনসারদের যৌথ টহল ছিল রাজধানীসহ দেশব্যাপী।
তৃতীয় দিন ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত মহাসড়কে কিছু যানবাহন চলাচল চোখে পড়েছে। প্রয়োজনেই এসব যানবাহনের সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাঁচাবাজার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকায়-মানুষের ভিড় ছিল। অকারণে কিংবা বিনা প্রয়োজনে বের হওয়ায় শনিবার আটক ও জরিমানা করা হয়েছে। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ ৬৩২ জনকে আটক করে। এবং জরিমানা করে মোট ৭০ হাজার টাকা। দুপুরে রাসেল স্কোয়ারে এক ব্রিফিংয়ে র্যাব জানিয়েছে আজ রবিবার থেকে তারা রাজধানীর মহল্লা ও অলিগলিতেও টহল দিবে। অকারণে কাউকে বাইরে বের হতে দেবে না। আগের দুদিনের তুলনায় আরও বেশি কঠোর হবে।
লকডাউনের তৃতীয় দিনে লক্ষ্য করা গেছে, বিধিনিষেধের মধ্যেও পাড়া-মহল্লার কোলাহল কমেনি। খোলা রয়েছে প্রায় সব ধরনের দোকানপাট। মানুষজন ইচ্ছেমতোই চলাফেরা করছে। অন্যদিকে মহল্লার রাস্তা ফাঁকা পেয়ে বেজায় খুশি শিশু-কিশোর-তরুণরা। রীতিমতো তারা ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠেছে। শনিবার মতিঝিলের গুপিবাগ, দক্ষিণ কমলাপুর, কমলাপুর বালুর মাঠ, জসিমউদ্দিন রোড, এজিপি কলোনি এলাকা ঘুরে এসব চিত্র উঠে এসেছে। এসব এলাকার মহলার ফাঁকা রাস্তায় আড্ডা দিতে দেখা যায় অনেককে। ছোট ছোট ফল ও সবজির অস্থায়ী দোকান গড়ে উঠলেও বিক্রির চেয়ে ক্রেতারা আড্ডাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। চায়ের দোকান না থাকলেও ফেরি করে চা-সিগারেট বিক্রি হচ্ছে সবখানে। গল্পে মেতে ওঠা অনেকেরই মুখে নেই মাস্ক। তবে এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনলেই যে যার মতো করে পাশের গলিতে ঢুকে পড়ছেন। সাইরেনের শব্দ শেষ হলে আবারও আড্ডাতে মেতে উঠছেন তারা।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরা বিমানবন্দর, কুড়িল বিশ্বরোড, বাডডা, মহাখালী ফার্মগেট, মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, জাতীয় প্রেসক্লাব ও পল্টন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এ সময় সেনাবাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। সব স্পটে পুলিশের নজরদারি রয়েছে। কয়েকটি স্পটে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করতেও দেখা গেছে। র্যাবের তৎপরতাও ছিল লক্ষণীয়। সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশকে যথেষ্ট ধৈর্য ধরেই মানুষকে বের হবার কারণ জিজ্ঞাসা করতে দেখা গেছে। যারা বেশি বাড়াবাড়ি করেছে তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে জরিমানা ও আটকের আদেশ দেয়া হয়েছে।
বেলা ১১টায় শনির আখড়া, কাজলা, যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ এলাকা ঘুরে দেখা যায়- এসব এলাকার মূল সড়কে মানুষ যত্রতত্র চলাচল করলেও কোন কড়াকড়ি নেই। আর যাত্রাবাড়ী-সায়দাবাদ সড়কে সিএনজি-প্রাইভেটকার চলাচল করলেও কোন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। শনির আখড়া-কাজলা সড়কে চেকপোস্টের কারণে গাড়ির চাপ কিছুটা কম। কিন্তু রিক্সার চাপে কিছু কিছু জায়গায় জটলা বেঁধে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে ভ্যানযোগেও যাত্রা করছেন। মাঝে মাঝে বাইক-সিএনজি আসলেও নানা অজুহাতে তারা যেতে পারছেন। তবে কাজলা থেকে যাত্রাবাড়ী নিচের সড়ক ভাঙ্গা থাকায় যানজট লক্ষ্য করা গেছে। এসব বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ বলছে, শনিবার সকাল থেকে রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। যারা বের হচ্ছেন নানা অজুহাত দেখাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণ পেলেই ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। অন্যথায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কিছু যানবাহনে থাকা যাত্রী ও চালক যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রিক্সাযোগে যাত্রা করা সুমাইয়া আশরাফ জানান, আমার বড় বোন অসুস্থ, তাই শনির আখড়া থেকে বাসাবো যাচ্ছি। কোন পরিবহন না থাকায় রিক্সায় রওনা হয়েছি। তবে রাস্তায় কেউ আটকায়নি। আমাকে আটকালেও যৌক্তিক কারণ তো আছে, আমি তো ঘুরতে বের হইনি। এই সময়ে কেউ ঘুরতে বের হয় না। এদিকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় যাত্রাবাড়ীতে ২৫ জনকে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। মাস্ক না পরা, বিধিনিষেধ অমান্য করে বের হওয়া, গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে লোক নেয়ায় অনেক গাড়ি ও পিকআপ চালককে জরিমানা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহনাজ হোসেন ফারিবা। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালত যাওয়ার পর যাত্রাবাড়ীতে আর কোন কঠোরতা দেখা যায়নি।
পুলিশের টহল ॥ তৃতীয় দিনেও পুলিশ ছিল বেশ তৎপর। দুপুরে রাসেল স্কয়ার মোড়ে দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট সুমন কুমার মোহন্ত। তিনি বলেন, এত কঠোরতা এবং সচেতনতার পরও অনেকেই ঘর থেকে বের হচ্ছেন। চেকপোস্টে জিজ্ঞেস করলে কোন কারণ বলতে পারছেন না। অহেতুক চলাচলকারীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কড়াকড়ি অবস্থানে প্রশাসন। তাই এই সডকে জরুরী খাদ্য ও পণ্যবাহী ট্রাক, রোগীবাহী এ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার ও রিক্সা ছাডা অন্য তেমন কোন যানবাহনের চলাচল নেই।
কঠোর অবস্থানে বিজিবি ॥ দুপুরে দেখা যায় কল্যাণপুর ফুটওভার ব্রিজের নিচে পুলিশ চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এম কে ইশমাম। ওই চেকপোস্টে ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে দেখা যায়, অসংখ্য মানুষ মিথ্যা বলে পার পাওয়র চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কাগজ দেখতে চাওয়ায় সবকিছু গরমিল। কেউ যাচ্ছেন সাভারের অফিসে, কেউ মিরপুর। সবারই জরুরী প্রয়োজন। কিন্তু ক্রস চেক করতে গেলেই সব উল্টো হয়ে যায়। চেকপোস্টে কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের।
মাঠে সেনাবাহিনী ॥ প্রথমদিনের মতোই গতকাল শনিবারও ছিল সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় তৎপরতা। পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে আবাসিক এলাকার বাজারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়। বেলা ১১টায় শুক্রাবাদ কাঁচাবাজার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ।
মিরপুরে একটু ঢিলে ভাব ॥ এদিকে শুরুর দুদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর অবস্থানে থাকলেও লকডাউনের তৃতীয় দিনে মিরপুরে গাছাড়া ভাব দেখা গেছে। শনিবার রাজধানীর বৃহত্তর মিরপুর এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
র্যাব থাকবে অলিগলিতেও ॥ আগের দুদিন মূল সড়কে তৎপর থাকলেও এখন থেকে র্যাব মহল্লায় ও গলিতে গলিতে টহল দেবে। সরকার নির্দেশিত বিধিনিষেধ লোকজনকে মানাতে পাড়া-মহলায়ও অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়ে র্যাব। শনিবার দুপুরে রাসেল স্কয়ারে লকডাউনে র্যাবের কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কামান্ডার খন্দকার আল মঈন।
আটক জরিমানা ॥ জানা গেছে, প্রথম দুদিনের মতো গতকাল শনিবারও ছিল আটক ও জরিমানার ব্যবস্থা। বিনা প্রয়োজনে বিধিনিষেধ পালন না করে বাইরে বের হওয়ায় ৬৩২ জনকে আটক করেছে পুলিশ। শনিবার সকাল থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত তাদের গ্রেফতার করা হয়। ডিএমপির পক্ষ থেকে বলা হয়- তৃতীয় দিনের লকডাউনে নিয়ম অমান্য করে বাইরে বের হওয়ায় ৬৩২ জনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ৭০ হাজার ৬৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে মতিঝিল বিভাগ এলাকায় বিধিনিষেধ অমান্য করে বাইরে বের হওয়ায় ১৫২ জন।
মহাসড়কে যান বেড়েছে ॥ কঠোর বিধিনিষেধের তৃতীয়দিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী এলাকায় যানবাহন চলাচল আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। চেকপোস্টগুলোতে পুলিশ কিছুটা নমনীয় হলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার কারণে মূলত যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনির আখড়া ও রায়েরবাগ চেকপোস্ট ঘুরে এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে।