বিডি ঢাকা অনলাইন ডেস্ক
মহিষটির নাম পাগলি। আশা বেগম নাম ধরে ডাকতেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে যায় মহিষটি। আশার বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নীলবোনা গ্রামে। তাঁর স্বামী মো. সেন্টু বলছেন, তাঁর খামারে এ রকম ২১টি মহিষ ছিল। সেখান থেকে ১৬টি মহিষ ৭ সেপ্টেম্বর রাতে পদ্মা নদীর স্রোতে ভেসে যায়।
পরে মহিষগুলো উদ্ধার করে বিজিবি। এখানে-সেখানে দৌড়ঝাঁপ করে মালিকানা ‘প্রমাণ করতে না পারায়’ সেগুলো আর ফেরত পাননি সেন্টু। অন্যদিকে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে গত বুধবার সন্ধ্যায় ১৫টি মহিষ নিলামে তোলা হয়। সেখানে সেন্টু মহিষগুলো কিনে নেন। মালিকানার প্রমাণ দিতে নিলামে কেনা মহিষগুলো গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে পাশের গ্রামে এনে ছেড়ে দেন সেন্টু। মহিষগুলো চেনা পথ ধরে দৌড়ে তাঁর খামারেই গিয়ে ওঠে।
ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় খামারিদের কয়টি গরু-মহিষ আছে, তার হিসাব রাখে বিজিবি। মহিষের বাচ্চা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজিবিকে অবহিত করে জন্মনিবন্ধন করাতে হয়। দুটি খাতায় তা লিখে রাখা হয়। একটি খাতা থাকে মালিকের কাছে, অন্যটি বিজিবির স্থানীয় ক্যাম্পে। গরু-মহিষের হিসাব ক্যাম্প কমান্ডার লিখে রাখেন তাঁর স্বাক্ষরসহ।
সেন্টু বলছেন, খাতায় তাঁর ২১টি মহিষ থাকার হিসাব লেখা আছে। তাঁর খাতার ক্রমিক নম্বর-২৯। ৮ সেপ্টেম্বর যখন তিনি দেখেন ১৬টি মহিষ হারিয়ে গেছে, তখন বিজিবি ক্যাম্পকে অবহিত করেই খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। এ নিয়ে সেদিনই গোদাগাড়ীর প্রেমতলী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে একটি অভিযোগও করেছিলেন।
৮ সেপ্টেম্বর তিনি জানতে পারেন যে রাজশাহীর চারঘাটের ইউসুফপুর বিজিবি ক্যাম্প কিছু মহিষ উদ্ধার করেছে। তিনি সেখানে গিয়ে মালিকানা দাবি করেন। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। একই দিন দুপুরে বাঘার আলাইপুর বিজিবি ক্যাম্পে আরও কিছু মহিষ উদ্ধারের খবর পান। তিনি সেখানেও যান। সেন্টু অভিযোগ করেন যে দুই ক্যাম্প থেকেই তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
সেন্টুর ভাষ্য অনুযায়ী, দুই ক্যাম্প থেকে মহিষগুলো বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে নেওয়া হয়। এরপর নিলামে বিক্রির জন্য বিজিবি সেগুলো কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের গুদামে পাঠায়। সেন্টু সেখানে গিয়েও মহিষগুলোর মালিকানা দাবি করেন।
মহিষগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করেন। মহিষগুলো যে তাঁর, সে ব্যাপারে এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন সোহেলের প্রত্যয়নও দেন। এরপর মালিকানা যাচাই করার জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি তদন্ত শেষে মতামত দেয়, এই মহিষ সেন্টুর নয়।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার হাসনাইন মাহমুদ। সদস্যসচিব সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহাফুল ইসলাম। সদস্য ছিলেন বিজিবির রাজশাহীর সহকারী পরিচালক নজরুল ইসলাম, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার কৌশিক আহমেদ এবং কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা ছাবেদুর রহমান।
হাসনাইন মাহমুদ ও কৌশিক আহমেদের উপস্থিতিতে বুধবার ও গতকাল রাজশাহী নগরের দাসপুকুরে শুল্ক গুদামে ১৫টি মহিষের প্রকাশ্যে নিলাম শুরু হয়। তখন সেখানে আসেন মহিষের মালিক দাবিদার সেন্টুও। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য লিটন হোসেনও।
প্রথম দিন যাঁরা নিলামে মহিষগুলো কিনেছিলেন, তাঁদের কিছু লাভ দিয়ে আবার সেগুলো কিনে নেন সেন্টু। দ্বিতীয় দিন তিনি নিজেই নিলামে অংশ নিয়ে মহিষগুলো কেনেন। মোট ১৫টি মহিষ কিনতে সেন্টুকে গুনতে হয় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা।
মহিষগুলো নিলাম করার সময় তদন্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার হাসনাইন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, সুজন আলী সাতটি ও সেন্টু নামের এক ব্যক্তি সব কটি মহিষ নিজের বলে দাবি করেছিলেন। তবে সুজন আলী তদন্তের মুখোমুখি হননি। আর তদন্তে প্রমাণিত হয়নি যে মহিষগুলো সেন্টুর। তাঁরা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে নিলামের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
নিলামের খবর পেয়ে এই প্রতিবেদকসহ তিন গণমাধ্যমকর্মী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সামনে সেন্টু দাবি করেন, মহিষগুলো তাঁর গ্রামে গিয়ে দিলে তাঁর খামারেই গিয়ে উঠবে। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কিছু হতে পারে না যে মহিষগুলো তাঁর। তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে চারটি মহিষ আছে, যেগুলো ১০ দিনের মধ্যে বাচ্চা দেবে। মালিক না হলে কেউ এত নিশ্চিত করে বলতে পারেন না।
সেন্টুর কথার সত্যতা যাচাই করতে গতকাল বেলা পৌনে একটার দিকে সাংবাদিকেরা তাঁর প্রথম চালানের নিলামের আটটি মহিষের গাড়ি অনুসরণ করেন। খামারির বাড়ির পাশের গ্রাম গহমাবোনায় মহিষগুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। মহিষগুলোর সঙ্গে শুধু একজন রাখাল দেওয়া হয়, যাতে কারও খেতে লাগতে না পারে। দেখা গেল, ছেড়ে দেওয়ার পর মহিষগুলো দৌড়ে যেতে থাকে। চেনা রাস্তা ধরে ঠিকই সেগুলো নীলবোনা গ্রামে খামারি সেন্টুর বাড়িতে গিয়ে ওঠে।
সেখানে সেন্টুর স্ত্রী আশা বেগম মহিষগুলোকে আদর করতে করতে কাঁদতে থাকেন। নিজের মহিষ কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য তিনি ‘পাগলি’ বলে একটি মহিষকে ডাকলেন। মহিষটি তাঁর কাছে এসে দাঁড়াল। আশা বেগম কাঁদতে কাঁদতে মহিষগুলোকে খাবার দেন। তাঁদের বাড়ির ছাদের ওপরে ধানের খড় রাখা হয়েছে। মহিষগুলো দেখতে আশপাশের বাড়ির মানুষ সেখানে ভিড় করেন।
সেন্টুর দাবির বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আটক করা এবং কাস্টমসে হস্তান্তর করাই তাঁদের কাজ। এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেওয়ার থাকলে তদন্ত কমিটি দেবে।
পরে যোগাযোগ করা হলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার হাসনাইন মাহমুদ বলেন, কাস্টমস কমিশনার কমিটি করে দিয়েছেন, যদি কিছু জানতে হয়, তাঁর কাছ থেকে জানতে হবে।
এ বিষয়ে আজ শুক্রবার সকালে কাস্টমস কমিশনার লুৎফর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তসংশ্লিষ্ট কাস্টমসের এক কর্মকর্তা বলেছেন, সেন্টু যে রেজিস্টারের বলে মহিষগুলো নিজের দাবি করেছেন, সেই রেজিস্ট্রেশনের সঙ্গে বিজিবির কাছে সংরক্ষিত রেজিস্টারের মিল পাওয়া যায়নি। একটি দলে অনেক কৃষকের মহিষ থাকে। হারানো মহিষগুলো একজনেরই হবে, এটা হতে পারে না।
মহিষগুলো বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, তাঁরা দীর্ঘদিন নদীর চরের বাথানে মহিষ রাখেন, মহিষগুলো তো বাড়িতে রাখা হয় না। বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটাও ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।
গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য লিটন হোসেন বললেন, নিজের মহিষ খামারিকে আবার টাকা দিয়ে কিনতে হলো। এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু হতে পারে না। এ তদন্ত সুষ্ঠু হয়নি। তিনি সিআইডি তদন্তের দাবি জানান। সুষ্ঠু তদন্ত হলে খামারি সেন্টু ক্ষতিপূরণ পাবেন বলে তাঁর বিশ্বাস।