বিডি ঢাকা ডেস্ক
বর্তমান সমাজের পরিবেশ দূষণের বহু কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো পলিথিনের অপব্যবহার। রাস্তার আশপাশে, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পার্ক, দোকানপাট কিংবা বাজারে সব জায়গাতেই পলিথিনের অবাধ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পলিথিন হলো একটি ক্ষতিকারক উপাদান। যা মাটিতে পড়ে বহু বছর ধরে অরক্ষিত থাকে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে পরিবেশ দূষণ করে। এক সময় পলিথিন যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি এখন পরিবেশের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের জন্য, পরিবেশ দূষণ এবং বন্যপ্রাণী হত্যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে কতটুকু কার্যকর? কেন আজও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না? কেন পলিথিনের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে? পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর বিধান অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশই ২০০২ সালের ১ মার্চ পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারপরেও পলিথিনের অপব্যবহার চলতেই থাকে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ১ অক্টোবর ২০২৪ পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তুপলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার পরও এই নিষেধাজ্ঞা মানছে ক’জন?
পলিথিন একটি প্লাস্টিক পণ্য। এটি প্রাকৃতিক পরিবেশে পচে যায় না বা গলে যায় না। এ জন্য এটি হাজার হাজার বছর ধরে মাটিতে বা জলে পড়ে থাকে, যার ফলে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন সমস্যা। পলিথিন প্রায় ১০০ থেকে ৪৫০ বছর পর্যন্ত পচে না। পলিথিন অপচনশীল হওয়ায় মাটির ওপরে অথবা মাটির নিচে পড়ে থাকলে এটি মাটি দূষণ করে। যা মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয় এবং কৃষি কাজে ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি করে। পলিথিনের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানগুলো মাটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যায় এবং মাটির প্রাকৃতিক গঠন পরিবর্তন করে। এর ফলে কৃষি জমিতে ফলন কমে যায়। আবার অনেক সময় পলিথিন নদী, খাল, সাগর এবং অন্যান্য জলাশয়ে দেখা যায়। কিন্তু এই পলিথিন যখন সাগর, নদী, পুকুর প্রভৃতি জায়গায় থাকে তখন এটি জলজ প্রাণীদের জন্য খুব বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। যার ফলে মাছ, কচ্ছপ, শামুক এবং আরও অন্যান্য জলজ প্রাণী যখন পলিথিন খেয়ে ফেলে তখন তাদের মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। যে কারণে সামুদ্রিক প্রাণীদের মৃত্যুহার ব্যাপকভাবে বাড়ছে। এমনকি ইকোসিস্টেমেরও ভারসাম্য দিন দিন নষ্ট হচ্ছে।
পলিথিনের কারণে যে শুধু মাটি দূষণই হচ্ছে তা নয়, বায়ু দূষণের ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। অনেক সময় দেখা যায় রাস্তার আশপাশে পরে থাকা পলিথিন বা গৃহস্থালির রান্নার কাজে অব্যবহিত পলিথিনগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। যার ফলে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয় এবং এই গ্যাস বাতাসের সঙ্গে মিশে বায়ু দূষণ হয়। আবার কিছু কিছু জায়গায় দেখা যায় পলিথিনের ময়লা এবং পলিথিনের খোলসগুলো খোলা জায়গায় পড়ে থাকে, যার ফলে শহরের সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যও নষ্ট হয়।
এমনকি রাস্তা, খাল, জলাশয় এবং উদ্যানগুলোতে পলিথিনের স্তূপ জমে থাকতে দেখা যায়। যার ফলে পরিবেশের দৃশ্যমান সৌন্দর্য নষ্ট হয় এবং এর জন্য মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী বা দোকানদার আছে, যারা কাপড়ের ব্যাগের মূল্য বেশি বলে তারা পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার করে এবং ক্রেতাদের পণ্যসামগ্রী পলিথিন ব্যাগে দেয়। ফলে দেখা যায়, পলিথিনে থাকা বিসফেনল এ (বিপিএ) ও Phthalates-এর মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কারণে মানবদেহে অনেক রোগের উৎপাত ঘটে যেমন- পেটের রোগ, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি রোগ হয়, যা মানুষের জন্য বিপজ্জনক। পলিথিন ব্যাগে কিছু এমন রাসায়নিক পদার্থও আছে, যা প্রজনন ক্ষমতায় বাধা সৃষ্টি করে এবং হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। এ ছাড়াও পলিথিন ব্যাগগুলোর ব্যবহার এতই বেড়েছে যে গৃহস্থালির আবর্জনায় এবং শহরাঞ্চলে আবর্জনায় প্রায়ই দেখা যায়।
অনেক সময় অধিকাংশ গৃহস্থালিতে পলিথিন ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য বহন বা সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। কিন্তু একবার ব্যবহারের পর সেই পলিথিন ব্যাগ সাধারণত পুনঃব্যবহার করা যায় না। ফলে ব্যাগগুলো দ্রুত জমা হয়ে যায় এবং পরিবেশে দীর্ঘদিন ধরে থেকে যায়, এমনকি বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ে। এ ছাড়াও পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার শুধু যে পরিবেশের ওপরেই প্রভাব ফেলে বিষয়টা তা নয়, বরং সমাজ এবং অর্থনীতিতেও ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পলিথিন ব্যাগের বর্জ্য যেমন নিষ্পত্তি খরচ বাড়ায়, ঠিক তেমন ভাবেই এটি শহরাঞ্চলে রাস্তা বা নর্দমায় জমে বাড়ায় জলাবদ্ধতাও। আবার অর্থনৈতিকভাবে শহরগুলোতে পলিথিন নিষ্কাশন করতে বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। যে কারণে অন্যান্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে বেশ বাধা তৈরি হয়।
পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও বাস্তবে এর ব্যবহার এখনো চলমান রয়েছে। তাই পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হলে শুধু যে আইনকানুনের ওপরই নির্ভর থাকতে হবে তা নয়। এর জন্য সামাজিক সচেতনতা এবং সক্রিয় জনসাধারণের অংশগ্রহণও প্রয়োজন। পলিথিন ব্যাগের এসব ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে কাগজের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, জুট বা থ্রেড ব্যাগ অথবা বায়োডিগ্রেডেবল ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে হবে। কারণ, এই ব্যাগগুলো পচনশীল, যা প্রকৃতিতে সহজেই মিশে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ দূষণের হাত থেকেও বাঁচায়। এ ছাড়াও ব্যবসায়ীদের পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের পরিবর্তে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে খাদ্য, ই-কমার্স বা ছোট ছোট ব্যবসায় অর্থাৎ, যাদের পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার একটি প্রচলিত অভ্যাস হয়ে গেছে, তাদের বিকল্প প্যাকেজিং ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এমনকি পলিথিন ব্যাগ সংগ্রহ করার জন্য উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও গড়ে তুলতে হবে।
সরকারকে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনে আরও কঠোর আইন এবং নীতি প্রণয়ন করতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন- টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব এবং বিকল্প উপকরণের ব্যবহার সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। এ ছাড়াও স্কুল, কলেজ ও জনগণের মধ্যে পলিথিনের ক্ষতিকর দিক এবং পরিবেশের প্রতি এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করতে হবে। যার ফলে আমরা একটি নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন এবং সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারব। পলিথিন মুক্ত পরিবেশই হোক ভবিষ্যৎ জীবন রক্ষার একমাত্র পথ।