পেঁয়াজ উৎপাদনে দেশের শীর্ষ জেলা হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর। এ জেলার কৃষকরা পিছিয়ে নেই পেঁয়াজের পর বীজ উৎপাদনেও। এই বীজকে ‘কালো সোনা’ বলে এ জেলার বাসিন্দারা। পেঁয়াজের বীজের ক্ষেতে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা।
চাষি হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে অংশ নিয়েছে। চলতি মৌসুমে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা বাণিজ্যের আশা কৃষি বিভাগের।
জানা যায়, সাদা ফুলে কালো বীজ, স্বর্ণের মতো দাম। তাই কৃষকরা এর নাম দিয়েছেন ‘কালো সোনা’।
দূর থেকে মনে হয় ভিন্ন কোনো সাদা ফুলের বাগান। আর এই ফুলের মধ্যে লুকিয়ে আছে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন। দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ চাষির পেঁয়াজের বীজের চাহিদা মেটায় ফরিদপুরের এই কালো সোনা। এ বছর ফরিদপুরে মাঠের পর মাঠ আবাদ হচ্ছে এ বীজের।
পেঁয়াজের গাছের গোলাকৃতি কদম ফুলের মতো সাদা ফুলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে মূল্যবান দানা। জেলা সদর ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলায় এ বছর বেড়েছে পেঁয়াজ বীজের চাষাবাদ।
জেলার বিভিন্ন মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠজুড়ে পেঁয়াজ বীজের গাছে সাদা ফুল। হাত দিয়ে পরাগায়ণের কাজ করছেন কিষান-কিষানিরা। পেঁয়াজ ভালো উৎপাদনের পর এ বছরও বাম্পার ফলন হয়েছে পেঁয়াজ বীজের।
চাষিরা জানান, বছরের শেষ দিকে আবাদ শুরু হয়ে ফলন ওঠে নতুন বছরের এপ্রিল-মে মাসে। পরে এক বছর বীজ সংরক্ষণ করে পরের বছরে করা হয় আবাদ ও বিক্রি। তাঁরা জানান, সার, কীটনাশক ও বীজের দাম বেশি হওয়ায় এ বছর আগের তুলনায় খরচ বেশি হয়েছে। প্রতি একরে ছয় থেকে আট মণ বীজ পাওয়া সম্ভব। প্রতি মণ বীজ ৬০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
পেঁয়াজ বীজ চাষি আকমল হোসেন বলেন, ‘আমি এ বছর ২০ একর জমিতে আবাদ করেছি। ছোট শিশুর মতো যত্ন করতে হয় পেঁয়াজের বীজের। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভালো হয়েছে ফলন। ক্ষেতে এখন পরাগায়ণের কাজ চলছে। সাধারণত মৌমাছি পরাগায়ণ করে থাকে, কিন্তু এ সময়ে মৌমাছি না থাকায় হাত দিয়েই পরাগায়ণ করা হচ্ছে। পরাগায়ণ করার ফলে ফলন ভালো হয় বিধায় এ কারণে কষ্ট হলেও খুব সাবধানে হাত দিয়ে পরাগায়ণ করছি।’
ফরিদপুর শহরের অম্বিকাপুরের নারী উদ্যোক্তা শাহিদা বেগম ২০০৪ সালে মাত্র ৪০ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ শুরু করেন। চলতি বছর তিনি ১০০ একর জমিতে বীজের চাষাবাদ করেছেন। দুই যুগের বেশি সময় ধরে এই বীজের আবাদ করে সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন। এআইপি (অ্যাগ্রিকালচারাল ইমপর্টেন্ট পারসন) পুরস্কারসহ পেয়েছেন নানা পুরস্কার। এই চাষির পথ অনুসরণ করে অনেকেই বীজ আবাদ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
নারী উদ্যোক্তা শাহিদা বেগম বলেন, ‘চলতি মৌসুমে ১০০ একর জমিতে পেঁয়াজের বীজ আবাদ করেছি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছরও ভালোই লাভবান হব। আমার ক্ষেতে প্রায় ৭৫ জন নারী-পুরুষ বীজ পরিচর্যার কাজ করছেন। এখন হাত দিয়ে পরাগায়ণের কাজ চলছে। এক থেকে দেড় মাস পর বীজ তোলা শুরু করব। তারপর মাড়াই এবং প্রক্রিয়াজাত করে বীজ প্যাকেট করা হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘শিশুসন্তানের মতো সারা বছরই যত্ন করতে হয় পেঁয়াজের বীজের। এ কারণেই আমার বীজের চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এরই মধ্যে অর্ডার পেতে শুরু করেছি। ভবিষ্যতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে বীজ রপ্তানি করার আশা আমার।’
সালথার ভাওয়াল ইউনিয়নের কামদিয়া গ্রামের চাষি নুর ইসলাম বলেন, ‘ফলন ভালো হলেও দুশ্চিন্তায় থাকি আমরা। কারণ ভারতের বীজ আসা বন্ধ করতে পারলেই আমরা লাভবান হতে পারব। প্রতিবছরই শুনতে পাই এ বছর ভারত থেকে বীজ আসবে না, কিন্তু বাস্তবে প্রতিবছরই বীজ দেশে আসে, আর আমাদের লোকসান হয়। এ ছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছে, তারা ভেজাল বীজ বাজারে বিক্রি করে আমাদের ক্ষতি করে দেয়। সরকারের এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো উচিত।’
রাজশাহী থেকে কাজ করতে আসা ছালাম শেখ বলেন, ‘পেঁয়াজ বীজ বপন করার সময় এসেছি। বীজ পরিচর্যা করছি, এরপর উত্তোলন, মাড়াই ও প্রক্রিয়াজাত করে তারপর বাড়িতে যাব। শুধু আমি একা নই, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার শ্রমিক এসেছেন কাজ করতে। যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেতে কাজ করছেন।’
পেঁয়াজ বীজ ক্ষেতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করছেন। নারী শ্রমিক শামেলা বেগম বলেন, ‘পেঁয়াজ বীজের সময় কাজ করে থাকি। বিশেষ করে পরাগায়ণের সময় ও উত্তোলন শেষে বীজ ধোয়ার কাজ করে থাকি। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেতন পাই। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে স্বামীকে সাহায্য করি। আবার ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা ও নিজের শখ পুরণের জন্যও এই টাকা কাজে লাগে।’