বিডি ঢাকা ডেস্ক
জ্বালানি বিষয়ক সংকটের কথা লিখতে গিয়ে আমার মনে হলো, নিয়মের বাইরে গিয়ে কীভাবে লেখাটা লেখা যায়, যাতে সবার কাছে তা সহজ বোধগম্য হবে। ভাবতে ভাবতে গল্প মাথায় এলো। তা দিয়ে শুরু করি।
অনেকদিন চার বন্ধু মিলে মিরপুরের সনিতে বসল। তাদের মধ্যে আমিও একজন। সনি সিনেমা হল এবং তার আশপাশের এলাকার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। নব্বই আর শূন্য দশকের সনি সিনেমা হলকেন্দ্রিক পরিবেশ আর নেই। এর দোতলায় একটি চীনা রেস্তোরাঁ ছিল, তাও এখন নেই।
রাস্তার ওপারে বড় গাছের তলায় শাহজাহানের ফুচকা ছিল, এখন নেই। কিন্তু এখন আছে ঝাঁ চকচকে দালান, ব্র্যান্ডের দোকান, আড়ং, প্রচুর পিৎজার দোকান আর ফুডকোর্ট। সনি থেকে চিড়িয়াখানার সুনসান রাস্তাটিও এখন জ্বলজ্বল করছে রুফটপ খাবারের দোকান, সুপারশপ আর অন্যান্য পসরা-সাজানো দোকানের ভিড়ে।
রেস্তোরাঁয় বসা চার বন্ধুর আড্ডা জমেছে। কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ এলো বিদ্যুতের কথা—
কল্যাণ: এই তোমাদের কার কার এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে?
আমি: কই মিরপুরে তো আমি এখনো পাইনি, যৎসামান্য মেইন্টেনেন্স ইন্টারাপশন ছাড়া।
শাতিল: ডিওএইচএস এলাকায় তো দেখছি না।
আমি: তুমি তো থাক এলিট পাড়ায়, তোমারটা বাদ।
রাহুল: আমার ওদিকে লোডশেডিং বলতে তেমন কিছু দেখি নেই। ঢাকার বাইরে কী অবস্থা কে জানে!
আমি: হ্যাঁ, আগে তো এমন ছিল, ঢাকার ঝলমল আলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে, মফস্বলে বিদ্যুৎ আসা যাওয়ার মধ্যে ছিল। অবশ্য গণমাধ্যমে তা উঠে এসেছিল।
শাতিল: নিজের গায়ে না পড়লে কেউ কি অন্যের দুঃখ বোঝে?
কল্যাণ: (ফুট কেটে) তা চাণক্য কী বলেন এই বিষয়ে?
আমি: তুমি আবার প্রাচীন অর্থনীতি শুরু কইরো না। শাতিল অর্থনীতি পাইলে আর কিছু বোঝে না।
রাহুল: কিন্তু এবার পত্রিকায় ঢাকার বাইরে লোডশেডিং হচ্ছে এমন খবর দেখিনি।
কল্যাণ: ফেসবুক কী বলে, এখন তো সংবাদের উৎস সেখানেই।
আমি: আমার চোখে তেমন গুরুতর অভিযোগ দেখিনি।
কল্যাণ: অথচ জ্বালানি উপদেষ্টা কিন্তু খুব ভয় দেখাচ্ছিলেন।
আমি: উনি সাবধান করছিলেন, এসি যদি ২৫ এর নিচে চালানো হয়, তবে বেশি পাওয়ার লাগবে, সেইজন্য একটু আধটু নরমে গরমে বলছিলেন।
কল্যাণ: কিন্তু আমার বাসায় যদি আমি ২০-এ এসি চালাই, এটা উনি জানবেন বা ধরবেন কী করে?
রাহুল: মনে হয় ফিডারের কারেন্ট দেখে। উনি বলেছিলেন, ফিডারের স্বাভাবিক কারেন্টের বেশি গেলে ধরে নিতে হবে কেউ কেউ এসি বেশি চালাচ্ছে।
আমি: ছোটবেলায় দেখতাম, তোদের মনে আছে, রোবোকপ?
কল্যাণ: হ্যাঁ হ্যাঁ, ‘কোথাও অপরাধ ঘটতে চলেছে’ এমন বলতো।
শাতিল: তুই কি এখন বলতে চাস—‘কোথাও এসি ২৫-এর নিচে চলেছে’ এভাবে সাবস্টেশনগুলোয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কথা বলে উঠবে?
আমি: হা হা হা। অসম্ভব কি?
শাতিল: শেষে বিদ্যুতের খরচ আবার বেড়ে যাবে, পাড়ায় পাড়ায় ট্রান্সফরমারের সাথে দামি এ-আই প্রযুক্তি লাগিয়ে এইসব করতে গিয়ে।
রাহুল: তা স্মার্ট গ্রিডের কাজ তো অনেকটা এমনই, ওই রোবোকপের মতো।
আমি: আমাদের গ্রিড তো স্মার্ট না।
শাতিল: কল্যাণ, তুই দেখ তো আমাদের জেনারেশনের কী অবস্থা?
কল্যাণ: কীভাবে দেখে?
আমি: পিজিসিবি বা পিডিবির ওয়েবসাইট চেক কর, পেয়ে যাবি।
[কল্যাণ আবার টেকনিক্যাল বিষয় ভালো বোঝে, চট করে সব বের করে ফেলে]
কল্যাণ: এই যে দেখ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) সাইটে পেলাম, ২৬-০৩-২০২৫ এর ডেটা, ২৫ মার্চের জেনারেশনের ভিত্তিতে ফোরকাস্ট করেছে।
আমি: কই দেখি!
[সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে ডেটা (https://misc.bpdb.gov.bd/daily-generation?date=26-03-2025) দেখার জন্য, রাহুল তাড়াহুড়ায় তার জুসের গ্লাসটা ফেলে দেয়, ভাগ্যিস কাগজের গ্লাস ছিল!]
আমি: দেখ, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বত্রিশটা প্ল্যান্ট বসা! কয়েকটা কিন্তু বড় ক্যাপাসিটির। ৩৬০ মেগাওয়াট একটা। ১৪০টা কেন্দ্রের মধ্যে ত্রিশটাই বন্ধ, মানে প্রতি পাঁচটার মধ্যে একটা বন্ধ। এখানে আবার তারিখ পরিবর্তন করে দেখারও সুযোগ আছে।
রাহুল: মেইনটেন্যান্স তো জরুরি বন্ধু!
শাতিল: কিন্তু এতগুলা বন্ধ থাকলে চলবে কীভাবে?
কল্যাণ: চালু আছে সেগুলো দেখ, কম কোথায়? আমদানিও চলছে, ১০০০ মেগাওয়াট।
আমি: টোটালটা দেখ। মোট স্থাপিত ক্ষমতা ২৭৫৩৬, ডিরেটেড ক্যাপাসিটি একটু কমে ২৬-সামথিং, আর সকালের পিক লোড ১৩৪৩০, আর সন্ধ্যার পিক লোড ১৪৪৯২। [সব মেগাওয়াটে]
শাতিল: একটা জিনিস লক্ষ কর, পিক লোডের প্রায় দ্বিগুণ কিন্তু সক্ষমতা আছে, কিন্তু আমরা সবটা পাচ্ছি না কেন?
আমি: সঞ্চালন লাইন পর্যাপ্ত না থাকতে পারে। এটা একটা বড় কারণ, সেটা প্রায়ই খেয়াল করা হয় না।
রাহুল: আরেকটা হিসাব দেখ। ওই যে বললে না, যে প্রতি পাঁচটার একটা বন্ধ, তার মানে ডিরেটেড ক্যাপাসিটির ২০ শতাংশের মতো হিসাব করলে দাঁড়ায় … দাঁড়ায় … [সেলফোনে ক্যালকুলেটরে জটিল হিসাব করে] এই যে প্রায় ২১-হাজার মেগাওয়াট।
আমি: আর পিক প্রায় ১৪-হাজার সামথিং। তারপরও ঘাটতি থাকছে।
কল্যাণ: এই ঘাটতিটা পূরণ হওয়া দরকার।
শাতিল: আচ্ছা কানেক্টেড লোড কত?
রাহুল: জটিল প্রশ্ন। কিন্তু শতভাগ সংযোগ আছে এটা তো শুনলাম।
আমি: সংযোগ থাকা, বিদ্যুৎ থাকা আর আসল লোড যা সাপ্লাই দেওয়া সম্ভব—এই হিসাবগুলো কিন্তু আলাদা আলাদা।
শাতিল: এই হিসাবগুলো আমাদের জানতে হবে।
আমি: তুই তো অর্থনীতিকের বিরাট শিক্ষক, জেনে নে, রিসার্চ শুরু কর।
শাতিল: করতে হবে।
রাহুল: তাহলে কি লোডশেডিং হবে?
আমি: লোড বেড়ে গেলে, যদি সাপ্লাই না দেওয়া যায়, যদি জ্বালানি কেনা না যায়, তাহলে তো ফোর্সড শাটডাউনে থাকতে হবে।
রাহুল: জ্বালানি মজুদের কী অবস্থা?
আমি: দেখ তো কল্যাণ, হাইড্রোকার্বন ইউনিট কী বলে?
[কিছুক্ষণ ঘেঁটে ঘেঁটে কল্যাণ বলে]
কল্যাণ: একটু সময় দে, এখানে ডেটা অত স্ট্রাকচারড না, …আরেকটা পিৎজার অর্ডার দে না …
[পিৎজার অর্ডার দিয়ে …]
রাহুল: তাহলে লোডশেডিং?
আমি: হলে হবে, কী আর করা!
শাতিল: এড়ানো যায়?
আমি: যায়, বিতরণ লাইনের ক্ষমতা বাড়িয়ে, সঞ্চালন লাইনের ক্ষমতা বাড়িয়ে, স্মার্ট গ্রিড ইমপ্লিমেন্ট করে—এই রকম আরও কিছু টোটকা তোকে বলতে পারি।
শাতিল: প্রতিটিই খরচযোগ্য। একনেক লাগবে এগুলো পাশ করতে করতে…
কল্যাণ: হ্যাঁ আমরা একটু স্লো মুভিং, দেখ না পিৎজাটাও তো আসে না…
রাহুল: তুই জ্বালানির কথাটা একটু বল তো।
আমি: আমরা তো এখন গ্যাস, হেভি ফুয়েল ওয়েল, হাই ডিজেল ওয়েল এগুলো নিয়েই কাজ করছি। আবার সেই ডেটাটা দেখ, সবই জীবাশ্মের জয়জয়কার।
রাহুল: কিছুটা তো নবায়নযোগ্য বা রিনিউয়েবল আছে।
আমি: আছে, কম।
কল্যাণ: আর ক্যাপটিভ পাওয়ার?
আমি: কম না, তবে তাও সব ডিজেল বা গ্যাস চালিত।
কল্যাণ: গ্যাসের কী অবস্থা?
আমি: নতুন কূপ খোঁড়া না হলে আর গ্যাস আসবে কোত্থেকে? প্রাকৃতিক সম্পদ তো আর আজীবন থাকবে না!
শাতিল: এলএনজি আমদানি হচ্ছে না?
আমি: হচ্ছে মনে হয়, তবে বাড়াতে হবে, বাড়ালেই …
শাতিল: ডলার লাগবে।
কল্যাণ: ডলার গেলেই, দাম বেড়ে যাবে, তোর ওই ভর্তুকি বাড়াতে হবে।
আমি: সেই জন্যই গরিবের দুই পয়সা উপদেশ—এসি ২৫-এ রাখ।
[সমস্বরে হা হা হা, এর মধ্যেই পিৎজা এসে গেল, উদরপূর্তির চেয়ে বড় জ্বালানি সমস্যা আর নাই]
ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ।। অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ এবং সাবেক পরিচালক, জ্বালানি ও টেকসই গবেষণা ইন্সটিটিউট; বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়