শিবচর (মাদারীপুর) সংবাদদাতা :ঈদ উপলক্ষে গার্মেন্টকর্মী মায়ের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বালীগ্রাম ফিরছিল ১৪ বছরের ছোট্ট রিফাত। বাবার কাজ থাকায় সে নারায়ণগঞ্জেই থেকে যায়। ঈদের দুদিন পর আসবে বাবা। তাই গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ছোট বোন আজমীরিকে নিয়ে মায়ের সঙ্গেই ঈদ করবে রিফাত।
ঈদের কেনাকাটা করে তাইতো পথে পথে অনেক ভোগান্তির শিকার হয়ে বুধবার (১২ মে) দুপুরে শিমুলিয়া ঘাটে এসে পৌঁছায় রিফাত, তার মা নিপা বেগম, চাচা গার্মেন্টকর্মী উজ্জল বেপারী, শাকিল বেপারী ও মো. ইমরান। ঘাটে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর বাংলাবাজার ঘাট থেকে রোরো ফেরি এনায়েতপুরী ১৫টি যানবাহন নিয়ে শিমুলিয়া ঘাটে এসে পৌঁছায়। এসময় ফেরিটি যানবাহন ঘাটে নামানোর আগেই শিমুলিয়া ঘাট থেকে প্রায় ৫ হাজার যাত্রী ফেরিতে উঠতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে রিফাত, তার মা নিপা বেগম ও তার এক চাচা ইমরানও ফেরিটিতে উঠে পড়ে। তবে যাত্রীদের এতই হুড়োহুড়ি ছিল যে রিফাত, তার মা ও চাচা ইমরান তিনজন তিন প্রান্তে হারিয়ে যায়।
এ অবস্থায় তারা যে যেখানে ছিল সেখানেই কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকে। রিফাতের বাকি দুই চাচা উজ্জল ও শাকিল ফেরিটিতে উঠতে না পেরে পরবর্তী ফেরির অপেক্ষায় পাড়েই দাঁড়িয়ে থাকে। যাত্রী বোঝাই করে প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর যাত্রীদের চাপে লোড করা যানবাহন শিমুলিয়া ঘাটে না নামিয়েই যাত্রী বোঝাই ফেরিটি আবার বাংলাবাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। প্রচণ্ড গরমে দীর্ঘ সময় তপ্ত রোদে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থেকে ফেরির মধ্যেই রিফাতে মা নিপা বেগমসহ ফেরির অন্যান্য যাত্রীরা শারীরিকভাবে অসুস্থ হতে শুরু করে। ফেরিটি মাঝ পদ্মায় যখন পৌঁছে তখন ফেরিটির শতাধিক যাত্রী অসুস্থ হয়ে নিচে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। অন্য অসুস্থ যাত্রীদের সঙ্গে নিপা বেগমও অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেরির ওপর পড়ে যায়। কিন্তু ছেলে রিফাত ফেরির অন্য প্রান্তে থাকায় বুঝতেই পারেনি তার মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
এ অবস্থায় ফেরিটি বাংলাবাজার ৩নং ঘাটে আসার সঙ্গে সঙ্গে শতাধিক যাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গরম থেকে কোনোমতে বাঁচার চেষ্টা করে। রিফাত ফেরি থেকে নেমে তার মাকে চার দিকে খুঁজতে থাকে। তখনো সে জানে না তার মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আর ফেরির অন্য যাত্রীরা তার মায়ের মাথায় পানি ঢেলে বাতাস করে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছে। এসময় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ফেরিতে গিয়ে নিপা বেগমকে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে পাড়ে তুলে আনতে আনতেই তার মৃত্যু হয়।
প্রশাসনের হেফাজতে নিপা বেগমের লাশ রাখা হয়। এমনি সময় রিফাত তার মাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে উপস্থিত হয়। মরদেহটির ওপর চোখ পড়তেই রিফাত মা বলে চিৎকার দিয়ে লাশের ওপর পড়ে যায়। এসময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। পড়ে অন্য ফেরিতে রিফাতের দুই চাচা বাংলাবাজার ঘাটে এসে পৌঁছালে তাদের কাছে নিপা বেগমের লাশ হস্তান্তর করা হয়। ছোট্ট রিফাতের ঈদ আনন্দ গ্রাস করে নিল পদ্মা। ফেরিতে অসুস্থ পড়ে পড়া বরিশালের হিজলা উপজেলার হারুন মিয়াসহ (৪৫) ৪ জন মারা গেছে। এর আগে রো রো ফেরি শাহ পরানে শরীয়তপুরের পালং-এর আনসুর মাদবর (১৫) নামের এক কিশোর মারা যায়।
রিফাতের চাচা উজ্জল বলেন, আমার ভাই, ভাবি, আমি আমার ছোট ভাইসহ চারজন নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টে চাকরি করি। ঈদ উপলক্ষে বাড়ি ফিরছিলাম। ফেরিতে ভিড় বেশি থাকায় আমি আর আমার ছোট ভাই ফেরিতে উঠতে পারিনি। রিফাত, আমার ভাবি ও আমার ফুফাতো ভাই ইমরান এক ফেরিতে ছিল। সেখানেই গরমে অসুস্থ হয়ে আমার ভাবির মৃত্যু হয়েছে।
রিফাত বলেন, ঈদের সব কেনাকাটা করে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়িতে ছোট বোন আছে। সবাইকে নিয়ে ঈদ করব বলে মায়ের গার্মেন্ট ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি যাচ্ছিলাম। ফেরিতে আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এখন আমি মা কোথায় পাব।
ফেরি এনায়েতপুরির মাস্টার ইনচার্জ মো. রেজা মুঠোফোনে বলেন, শিমুলিয়ায় যাত্রী চাপে আমরা বাংলাবাজার থেকে নেওয়া গাড়িও নামাতে পারিনি। পরে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সেই গাড়ি নিয়েই ফিরে আসি। প্রচণ্ড গরমে এই ঘটনা ঘটেছে।
শিবচর থানার ওসি মো. মিরাজ হোসেন বলেন, ফেরি এনায়েরপুরিতে ৪ যাত্রী ও ফেরি শাহ পরানে ১ যাত্রী মৃত্যুবরণ করেছে। প্রচণ্ড গরমে হিটস্ট্রোকে এসব যাত্রীরা মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়েছে।