অনলাইন নিউজ : দেশে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। মাস দুয়েক আগে সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় কোভিডের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও বর্তমানে তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। হাসপাতালে আসা করোনা রোগীর ৫০ ভাগ গ্রাম থেকে আসছে বলে জানা গেছে। কঠোর লকডাউনের মধ্যেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণে বাড়ছে উদ্বেগ ।
গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরো ২০১ জনের মৃত্যু হয়েছে; যা দেশে এক দিনে মৃত্যুর রেকর্ড। এ পর্যন্ত করোনায় দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজার ৫৯৩ জনের। এর আগে ৫ জুলাই এক দিনে ১৬৪ জন মারা যাওয়ার রেকর্ড হয়েছিল। এ ছাড়া কয়েক দিন ধরে মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। গত ১ জুলাই ১৪৩, ২ জুলাই ১৩২, ৩ জুলাই ১৩৪, ৪ জুলাই ১৫৩ ও ৬ জুলাই ১৬৩ জনের মৃত্যু হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৩৭ হাজার ১৪৭ জনের। পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৬৩৯টি। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ। দেশে এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৬৮ লাখ ২৯ হাজার ৮৩২টি। মোট শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ২০১ জনের মধ্যে ৬৬ জনই খুলনার। এ ছাড়া ঢাকায় ৫৮, চট্টগ্রামে ২১, রাজশাহীতে ১৮, বরিশালে ৭, সিলেটে ৯, রংপুরে ১৪ এবং ময়মনসিংহে ৮ জন মারা গেছে।
এদিকে, খুলনা বিভাগে করোনা সংক্রমণ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। চট্টগ্রামে বেড়েই চলেছে করোনা শনাক্তের হার। ঝিনাইদহে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে ১১ জন ও সাতক্ষীরায় করোনার উপসর্গ নিয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সিরাজগঞ্জে করোনা শনাক্ত হয়েছে আরো ৮৯ জনের। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
খুলনা : খুলনা বিভাগে করোনাভাইরাস ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। একের পর এক প্রাণহানি ও শনাক্তের রেকর্ড ভাঙছে। আবারও করোনায় মৃত্যুর রেকর্ড ভেঙেছে এ বিভাগ। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এদিন মারা গেছে ৬৬ জন। একই সময়ে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনায়। কুষ্টিয়ায় ১১ জন, ঝিনাইদহে সাত, যশোরে ছয়, চুয়াডাঙ্গায় পাঁচ, নড়াইলে চার, বাগেরহাটে তিন, মেহেরপুরে দুই ও মাগুরায় একজন মারা গেছেন।
খুলনা বিভাগের মধ্যে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় চুয়াডাঙ্গায় গত বছরের ১৯ মার্চ। সংক্রমণের শুরু থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় মোট শনাক্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯৩৪ জন। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১ হাজার ৩২৫ জন। এ সময় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৪২ হাজার ৮৪৪ জন।
ঝিনাইদহ : কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না সীমান্তবর্তী জেলা ঝিনাইদহে করোনার সংক্রমণ। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যু ও শনাক্তের সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় ঝিনাইদহে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ১৫৬ জন। আক্রান্তের হার ৩৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। গতকাল সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম এ তথ্য জানান।
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ জানান, সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটে বর্তমানে ১১৫ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। শয্যাসংখ্যার তুলনায় বেশি রোগীর কারণে চিকিৎসা দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
সিলেট : সিলেট বিভাগে প্রতিদিন বাড়ছে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু ও শনাক্তের হার। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগে রেকর্ড ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া ৯ জনের মধ্যে সিলেটের ৭, সুনামগঞ্জের এক ও মৌলভীবাজারের একজন বাসিন্দা রয়েছে।
বিভাগে ১ হাজার ৪৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে আরো ৩৬২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয় এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তদের মধ্যে সিলেট জেলার ২১৩ জন, সুনামগঞ্জে ২৪, হবিগঞ্জে ৩১, মৌলভীবাজারের ৯৪ জন রয়েছেন। সব মিলিয়ে সিলেট বিভাগে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৭১৬ জনে।
সাতক্ষীরা : সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরায় যতই দিন যাচ্ছে, ততই করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার উপসর্গ নিয়ে ৫ নারীসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে জেলায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে মোট ৩৮৬ জন। আর ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৭৬ জন। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১৬০ জনের নমুনা পরীক্ষা শেষে ৪১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এ নিয়ে জেলায় আজ পর্যন্ত মোট করোনা আক্রান্ত হয়েছে ৩ হাজার ৯০৮ জন।
দিকে, চলমান কঠোর লকডাউনের সপ্তম দিনেও চলছে ঢিলেঢালাভাবে। লকডাউন উপেক্ষা করে শহরের হাটবাজারগুলোতে প্রচুর মানুষের ভিড় লক্ষ করা গেছে। সড়কগুলোতে অন্যান্য দিনের তুলনায় বেড়েছে মানুষের চলাচল। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মাঝে অনীহা দেখা গেছে।
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন শাফায়াত জানান, জনসচেতনতার অভাবে মানুষ লকডাউন লঙ্ঘন করছে। করোনা প্রতিরোধে তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ও মাস্ক পরার আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় শনাক্ত হয়েছে ৬১১ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা হলো ৬২ হাজার ২০০ জন। এর আগের দিনও ৬৬২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। গতকাল বুধবার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন ল্যাবে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৬৩৪ জনের করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। চট্টগ্রামে নতুন আক্রান্তদের মধ্যে নগরীতে ৬১১ জন এবং উপজেলায় ১৪৬ জন।
রাজশাহী : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টার মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। এরমধ্যে ২ জনের করোনা পজিটিভ ছিল এবং অন্য ১৮ জন উপসর্গ নিয়ে মারা যান। তবে তাদের মধ্যে একজন করোনামুক্তও হয়েছিলেন।
বুধবার রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, মৃতদের মধ্যে রাজশাহীর ৭ জন, চাঁপাইনবাগঞ্জ ২, নওগাঁর ৩, নাটোর ২, পাবনা ৪, কুষ্টিয়া ১ ও মেহেরপুরের ১ জন রয়েছে। মৃতদের মধ্যে ১৩ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী। এদের মধ্যে ১৪ জনের বয়স ৬১ বছরের ওপরে, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ২ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ২ ও ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সের ছিল ২ জন।
এ নিয়ে চলতি মাসেই হাসপাতালটিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১২১ জন। এদের মধ্যে ৩৪ জনের করোনা পজিটিভ ছিল এবং অন্যরা উপসর্গ নিয়ে মারা যায়।
এদিকে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধে সারা দেশের ন্যায় গত ১ জুলাই থেকে রাজশাহীতেও চলছে কঠোর লকডাউন। তবে কঠোর লকডাউনের ৭ম দিন দুপুর পর্যন্ত মহানগরীজুড়ে ব্যাপক জনসমাগম লক্ষ করা গেছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়াও বিভিন্ন অজুহাতে তারা রাস্তায় বের হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি দেখা গেছে। এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলাম জানান, রাস্তায় থাকা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদকালে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে বা জরুরি প্রয়োজন ছাড়াই বের হয়েছে এমনটি বোঝা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৮৯ জনের করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ২৭৬ জনের। আক্রান্তের হার ৩৩ দশমিক ৪৬ ভাগ। আক্রান্তদের মধ্যে সিরাজগঞ্জ সদরে ২২ জন , বেলকুচিতে ১৬, শাহজাদপুরে ১, রায়গঞ্জে ৬, কামারখন্দে ২, কাজিপুরে ২৮, উল্লাপাড়ায় ১১ এবং তাড়াশে ৩ জন রয়েছে।
এদিকে, সিরাজগঞ্জ শহরে সর্বত্র করোনা আক্রান্ত রোগীর তথ্য মিলছে। অনেকে জ্বর-কাশিসহ অন্য উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করে চিকিৎসা দিতে দ্রুত সুস্থ হচ্ছেন।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম ৩ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।
বগুড়া : বগুড়ায় বেড়েই চলেছে করেনা সংক্রমণ। এর সঙ্গে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ও উপসর্গে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে পাঁচজন ও উপসর্গে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন আরো ১৫৪ জন। পাশাপাশি বগুড়ার তিনটি হাসপাতালেও রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে রোগী রয়েছেন ২৬০ জন, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের ২০০ শয্যার মধ্যে ১৯৫ জন রোগী ও বেসরকারি টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও রফাতুল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতালে রয়েছেন ১১৫ রোগী।