বিডি ঢাকা ডেস্ক
লোহা লক্করের পথ পাড়ি দিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যায় ট্রেন। এই রেলপথ নির্বিঘ্ন রাখতে রাতদিন পরিশ্রম করে রেল দপ্তরের প্রকৌশল বিভাগ। এই বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ এক পদের নাম ট্রলিম্যান। মূলত রেলপথের ত্রুটি-বিচ্যুতি অনুসন্ধানে সাহায্য করেন এই ট্রলিম্যানরা।
আর মূল অনুসন্ধানের কাজটি করেন প্রকৌশলীরা। তাদের পথে পথে বয়ে বেড়ানোর দায়িত্ব ট্রলিম্যানদের। প্রাথমিক ত্রুটি সারানোর জন্য কাজ করেন যে মিস্ত্রি বা কিম্যান, তাদেরও বয়ে নিয়ে চলেন ট্রলিম্যানরা। রেলপথ নজরদারি বা চেকিংয়ের কাজ করা ওয়েম্যানদের কাজও সহজ করে থাকেন তারা।
নীলফামারীর ডোমারের চিলাহাটি থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত রেলপথ রয়েছে ৬১ কিলোমিটার। এ রেলপথে রয়েছে একজন ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী। তাকে বয়ে নিয়ে চলতে রয়েছে চারজন ট্রলিম্যান। তাদের মধ্যে একজন লিটন খান। ২০০৯ সালে সৈয়দপুর রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলীর অধীনে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। সেই থেকে রেলের এই কাজ করে আসছেন লিটন।
লিটন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ট্রলিম্যানের চাকরিটা মূলত ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী স্যারের সঙ্গে। উনি যেখানে যাবেন সেখানেই আমাদের ট্রলি নিয়ে যেতে হবে। ট্রলি বাদেও সড়কে বা ট্রেনে কাজ থাকলে যেতে হয়। আমাদের এটা হার্ডওয়ার্কিং জব। তবে হার্ডওয়ার্কিংটা সমস্যা না। সবচেয়ে বেশি পেইন আমাদের চাকরিটার নির্দিষ্ট কোনো টাইম নেই। চাকরিতে যেমন নিদিষ্ট একটা টাইম থাকে। সব সময় আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হয় কখন ডাক পড়ে।
যেহেতু ইমার্জেন্সি স্টাফ রাতদিন বলে কিছু নেই ট্রলিম্যানদের। যখনই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ডাক আসে তখনই ছুটে যেতে হয় তাদের।
ট্রলিম্যান কহিনুর মোড়ল ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাত ১২টার সময় আমার সাহেব ডাকে, আমাকে আসতে হবে। যদি বলে অমুক জায়গায় গাড়ি পড়েছে চলো আমাকে যেতে হবে। রাত আর দিন নাই ২৪ ঘণ্টাই ডিউটি। ব্রিটিশ যেটা নিয়ম করে গেছে সেইভাবেই সাহেবদের নিয়ে ট্রলি চালাচ্ছি। সাহেব যেটাই নির্দেশ করে সেটাই পালন করি। যদি হেডকোয়ার্টারে থাকি ঈদ আর পূজা নাই আমাদের ডিউটি চলবেই।
দুই ধরনের ট্রলি আছে রেলের। পুশ ট্রলি আর মোটর ট্রলি। ধাক্কা দিয়ে চালাতে হয় পুশ ট্রলি। ৩০ বা ৪০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে চলাচল করে পুশ ট্রলি। প্রকৌশলীসহ ৫–৬ জন এতে চড়তে পারেন। মোটর ট্রলি ২৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলাচল করে। ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে থাকে ১০ বা ১১ জন বহনে সক্ষম মোটর ট্রলি। লাইন ক্লিয়ার না থাকলে মোটর ট্রলি চলাচল করতে পারে না। পুশ ট্রলির অবশ্য ক্লিয়ারেন্স লাগে না। রেল গাড়ির মতোই মোটর ট্রলিও ব্রেক টেনে দিলেই গাড়ি জায়গাতেই দাঁড়িয়ে পড়ে না। আর পুশ ট্রলিতে ব্রেক থাকেই না। তাই সতর্কতাই আত্মরক্ষার এবং দুর্ঘটনা এড়ানোর উপায়।
পুশ ট্রলিগুলোর বডি হয় কাঠের আর চাকা লোহার। ট্রলিতে থাকে গজ বা লোহার পাত যা দিয়ে লাইনের প্রস্থ মাপা হয়। মিটার গেজ লাইনের গজ হয় তিন ফুট তিন ইঞ্চি তিন সুতা। গজ যদি ঠিকঠাক না আঁটে তখন মেরামতের প্রশ্ন আসে। ট্রলিতে ওয়েল্ডিং মেশিন, শাবল, গাইতি, করাত, কাটিং মেশিন ইত্যাদিও রাখা হয় জরুরি সময়ে। ট্রলিতে চড়ে প্রকৌশলী লক্ষ্য রাখেন দুটি রেল সমান লেভেলে আছে কিনা, দুটিকে জোড়া দেওয়ার আংটা বা নাট-বল্টুগুলো ঠিকঠাক আছে কি না, লাইন কোথাও বেঁকে গেছে কি না, স্লিপারের সঙ্গে জোড়া দেওয়া রেল বারের আংটা ছুটে গেছে কি না।
ছোটখাটো প্রয়োজনে ট্রলিতে যন্ত্রপাতি থাকা সাপেক্ষে নিজেরাই মেরামত করেন অথবা মিস্ত্রিকে ডেকে পাঠান। সাধারণত প্রতি ৬ কিলোমিটার রেলপথে প্রকৌশল দপ্তরের একজন করে মিস্ত্রি বা কিম্যান থাকে। সামান বাক্স থেকে রেঞ্চ, হাতুড়ি, শাবল, করাতের মতো জিনিসপত্র নিয়ে তিনি হেঁটে বেড়ান রেললাইন ধরে। রেল বা লোহার বারের কোথাও কিছু ঢিলা হয়ে থাকলে টাইট দেন, আগাছা পরিষ্কার করেন, পাথর সরে গেলে নির্দিষ্ট স্থানে এনে গুছিয়ে রাখেন।
পুশ ট্রলি লাইনে নামাতে লাইন ক্লিয়ার থাকা লাগে না। শুধু সামনের ও পেছনের স্টেশন মাস্টারকে জানিয়ে রাখা লাগে। এমনিতেও সময়সূচি হিসেব করেই পুশ ট্রলি লাইনে নামে। যেমন কোনো আন্তঃনগর স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর দেড় বা দুই ঘণ্টা যদি ফাঁকা সময় থাকে সেটা পুশ ট্রলির টাইম। আর যদি কোনো ট্রেন চলেই আসে তবে ভাগ ভাগ করে ট্রলি লাইনের পাশে সরিয়ে নেওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে।
লিটনসহ অন্য তিনজন এ রেলপথে যে ট্রলিটি চালান সেটি পুশ ট্রলি হলেও দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর জন্য শ্যালোমেশিন সেট করেছেন তারা। পুশ ট্রলিতে ব্রেক না থাকলেও এই ট্রলিটি থামানোর জন্য লাগানো হয়েছে ব্রেক।
ট্রলিম্যান প্রদ্যুৎ কুমার মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে ছিল পুশ ট্রলি। স্যারের সুবিধার্থে আমরা মেশিন লাগিয়েছি। যেহেতু ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্ট সেজন্য তাড়াতাড়ি যেতে এই মেশিন ভালো কাজে দেয়। মূলত আমাদের পুশ ট্রলি। আমরা মেশিন ট্রলি করে নিয়েছি। ট্রেনে সময়সূচি হিসেব করেই লাইনে নামি আমরা। এরপরও কোনো ট্রেন চলে আসলে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে সরিয়ে নেই আমরা।
রেলের চলার স্বার্থে অনেকটা ভূমিকা পালন করে ট্রলিম্যানরা। যে কোনো জরুরি মুহূর্তে তারা সব ধরনের কাজ করে থাকেন।
সৈয়দপুর রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) সুলতান মৃধা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদেরও ২৪ ঘণ্টা ডিউটি, ট্রলিম্যানদেরও। অর্থাৎ আমার ডিপার্টমেন্টের সবার ২৪ ঘণ্টা ডিউটি। কেউ বলতে পারবে না আমি ডিউটি করে আসছি আর যেতে পারবো না। কাজে যেতেই বাধ্য তারা। ট্রলিম্যানরা সব সময় আমাদের হেল্প করে। ওয়েম্যানদের সব সময় পাশে থাকে এটি হলো নিয়ম তাদের। তাদের কাছে লাইনের যেসব কাগজপত্র তারাই অফিসারের প্রোগ্রামের সময় এসব নিয়ে যায়।