সিলেট সংবাদদাতা : সিএনজি অটোরিক্সায় গ্রিল না লাগানো এবং সব পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে সিলেটে টানা ধর্মঘট পালন করছে পরিবহন শ্রমিকরা। আর চলমান এ পরিবহন ধর্মঘটকে অযৌক্তিক দাবি করে সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এ ধর্মঘটে শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টি সিন্ডিকেট আন্দোলন। একই সঙ্গে আন্দোলনের মাধ্যমে আদালত অবমাননা করা হচ্ছে। আর এই সিন্ডিকেটের কাছে কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছেন সিলেটবাসী।মূলত: সিলেটের কতিপয় পরিবহন শ্রমিক নেতা নামধারী ব্যক্তি তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ উদ্ধারে শ্রমিকদের ব্যবহার করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় রয়েছেন। দীর্ঘদিন যাবত এ সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের এসব কার্যক্রম। চলমান এ ধর্মঘট তাদের ব্যবসা প্রসারের একটি নতুন ক্ষেত্র।সিলেটে পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে পাথর ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকা বিভাগজুড়ে ৭২ ঘণ্টার ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন আজ বুধবার সকালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে ধর্মঘট পালন করতে দেখা গেছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের। কোথাও চলছে না যানবাহন। এতে করে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারন করেছে। অনেককে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। তবে নগরীতে হালকা ও প্রাইভেট যান চলাচল করছে। রিকশা ও পাঠাওয়ের মোটরসাইকেলের মাধ্যমে জরুরি কাজে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা। সিলেট ডিপো থেকে ছেড়ে যাওয়া বিআরটিসির ভোলাগঞ্জগামী একটি বাস আটকিয়ে চাকা পাংচারসহ যাত্রীদের হয়রানি করেছে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। কুমারগাও পয়েন্টে সুনামগঞ্জগামী বিআরটিসি বাস আটকিয়ে যাত্রী সাধারণের সঙ্গে অনৈতিক আচরণ করে স্থানীয় শ্রমিকরা।বিআরটিসি সিলেট ডিপো ম্যানেজার মো. জুলফিকার আলী জানান, সিলেটবাসীর পরিবহন সুবিধার্থে চালু করা বিআরটিসির দুটি বাস ছেড়ে গেলেও পথিমধ্যে পরিবহন শ্রমিকরা তা আটকে রাখে। তবে বাস মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, বাস মালিক সমিতি ধর্মঘটে নেই। শ্রমিক সংকট থাকায় বাসগুলো তারা চালাতে পারছেন না।
আর পণ্য পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাথর কোয়ারি খুলে না দেওয়ার ফলে শ্রমিকরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। কাজ নেই, বাসে যাত্রী নেই। এজন্য তারা গণপরিবহণকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মঘট করছেন।বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেন, পাথর উত্তোলনের দাবি কিংবা কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবি যেটাই হোক না কেন, সেই দাবির সমর্থনে বা দাবি নিয়ে যদি কেউ আন্দোলন করে এবং পাথর শ্রমিকদের দোহাই দিয়ে পরিবহন ধর্মঘট করে তা অযৌক্তিক। কারণ সব পরিবহন পাথর সম্পর্কিত নয়। আবার পরিবহনের একমাত্র পণ্য তো পাথর না। আর সিলেটের যেসব পাথর কোয়ারি নিয়ে আদালতে রিট বা রায় আছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে আদালতের রায় না মানার কারণে আদালত অবমাননারও আদেশ আছে। সব মিলিয়ে এই বিষয়ে ধর্মঘট করা বা ধর্মঘটে সমর্থন করা আদালতের রায়ের পরিপন্থী একটি কার্যক্রম। এটি আদালত অবমাননা। আর এই কার্যক্রমের সঙ্গে যারা জড়িত বা যারা সমর্থক বা বন্ধ করার দায়িত্ব থেকেও যারা বন্ধ করছেন না তারা সকলেই আদালত অবমাননা করছেন।সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পরিবহন নেতারা বর্তমানে শ্রমিকদের কথা বললেও বিগত বছরগুলোতে পাথর কোয়ারিতে যেসব শ্রমিক মারা গেছেন তারা কী তাদের আর্থিক সহযোগিতা করেছেন? যদি তারা সহযোগিতা না করেন তাহলে হঠাৎ তারা শ্রমিক দরদি হয়ে উঠলেন কেন? আর পরিবহন ধর্মঘট ডেকে এসব নেতারা মহামান্য হাইকোর্টের আদেশকে লঙ্ঘন করছেন। আমরা আশা করবো, মহামান্য হাইকোর্ট এ বিষয়ে আদালত অবমাননার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম চলমান পরিবহন ধর্মঘটকে ‘সিন্ডিকেট’ আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করে বলেন, পাথরখেকোদের কালো টাকার কাছে শ্রমিক নেতারা বিক্রি হয়ে এই ধরণের আন্দোলন করছেন। এটি কালো টাকার ক্ষমতা হিসেবেও দেখতে হবে।সিলেট জেলা ট্রাক পিকআপ-কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু সরকার বলেন, আমাদের নির্ধারিত আন্দোলন চলবে। কারণ আমরা সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থেকে নড়ছি না। আর জেলা প্রশাসক আমাদেরকে তার সীমাবদ্ধতার জায়গা দেখিয়েছেন। সেজন্য আমরা এখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার অপেক্ষায় আছি। আমরা চাইছি প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে কোনো নির্দেশনা দিন। এজন্য আমরা পরিবহন ধমর্ঘটের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নজরে বিষয়টি দিতে চাইছি। কোয়ারিতে যখন মানুষ যায় তখন কিন্তু সবাই গাড়িতে যায়। আর এই যাত্রীদের কেন্দ্র করেই কিন্তু আমরা গাড়ি কিনেছি। কিন্তু কোয়ারি বন্ধ থাকায় বর্তমানে যাত্রী নেই। সেজন্য তাদেরকে যুক্ত করা হয়েছে। সিএনজি অটোরিকশার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
যাত্রীর সঙ্গে কোয়ারির সম্পর্ক কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোয়ারি চালু হলে বাসগুলোতে ৭০ শতাংশ যাত্রী বাড়বে। কারণ শ্রমিকরা বিভিন্ন এলাকা থেকে পাথর কোয়ারিতে যান। পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার মতো পরিবেশ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দাবি হলো আমরা কাজ করবো, ভাত খাবো। এর বাইরে আর কোনো দাবি আমাদের নেই।সিলেট জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, বাস মালিক সমিতি পরিবহন ধর্মঘটের সঙ্গে নেই। শ্রমিক সংকট থাকায় আমরা বাস চালাতে পারছি না।প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে ধর্মঘট শুরু হয়েছে। চলবে ২৪ ডিসেম্বর শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত। ধর্মঘটে সিলেট বিভাগের তিন জেলায় বাস, ট্রাক, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, কোচ, লেগুনা, ট্যাংক লরি, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ সব গণপরিবহনের চলাচল বন্ধ থাকার কথা জানানো হয়। তবে অ্যাম্বুলেন্স, বিদেশগামী যাত্রী, ফায়ার সার্ভিস, সংবাদপত্র ও জরুরি ওষুধ সরবরাহের গাড়ি ধর্মঘটের আওতামুক্ত থাকবে।