নিজস্ব সংবাদদাতা : ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে সারাহ বেগম কবরীর অভিনয় শুরু। চট্টগ্রামের মেয়ে মিনা পাল চলচ্চিত্রের লাল-নীল জগতে পা দিয়েই নতুন নাম পান ‘কবরী’। দক্ষ অভিনয়শৈলী দিয়ে ‘মিষ্টি মেয়ে’ হয়ে ওঠা এই অভিনেত্রীর জীবনের নানা দিক পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
মিনা পাল থেকে কবরী
১৯৬৪ সাল। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত নির্মাণ করবেন ‘সুতরাং’ শিরোনামের একটি ছবি। সেই ছবির জন্য চট্টগ্রাম থেকে আনলেন মিনা পাল নামের একটি কিশোরীকে। সুতরাং ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে মিনা পালের ফিল্মি নাম হয়ে গেল কবরী। সুতরাং মুক্তি পেলে এ ছবি এবং ছবির নায়িকা হিসেবে কবরী দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হন। তারপর জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় কবরীর শুধুই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা। এরপর অভিনয় করেছেন হীরামন, ময়নামতি, চোরাবালি, পারুলের সংসার, বিনিময়, আগন্তুকসহ জহির রায়হানের তৈরি উর্দু ছবি ‘বাহানা’ এবং ভারতের চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। একদিকে দক্ষ অভিনয় অন্যদিকে মনকাড়া হাসি দিয়ে সহজেই তিনি দর্শক হৃদয় হরণ করে। তাই দর্শক তাকে ‘মিষ্টি মেয়ে কবরী’ আখ্যা দিতে ভোলেননি। ১৯৭৮ সালে শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মিত ‘সারেং বউ’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
জন্ম চট্টগ্রামে
সারাহ বেগম কবরী ষাট দশকে চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কবরীর জন্মস্থান বোয়ালখালী হলেও শৈশব ও কৈশোর বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরীতে। তার আসল নাম মিনা পাল। পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং মা শ্রীমতি লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভাব কবরীর।
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
সুতরাং (১৯৬৪), জলছবি (১৯৬৫), বাহানা (১৯৬৮), আবির্ভাব (১৯৬৮), যে আগুনে পুড়ি (১৯৬৮), দ্বীপ নেভে নাই (১৯৭০), দর্পচূর্ণ (১৯৭০), ক খ গ ঘ ঙ (১৯৭০), বিনিময় (১৯৭০), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), রংবাজ (১৯৭৩), মাসুদ রানা (১৯৭৪), সুজন সখী (১৯৭৫), সাধারণ মেয়ে (১৯৭৫), গুন্ডা (১৯৭৬), নীল আকাশের নীচে (১৯৭৬), ময়নামতি (১৯৭৬), আগন্তুক (১৯৭৬), আঁকাবাঁকা (১৯৭৬), কত যে মিনতি (১৯৭৬), অধিকার (১৯৭৬), স্মৃতিটুকু থাক (১৯৭৬), সারেং বৌ (১৯৭৮), বধূ বিদায় (১৯৭৮), আরাধনা (১৯৭৯), বেঈমান (১৯৭৯), অবাক পৃথিবী (১৯৭৯), কাঁচ কাটা হীরা (১৯৭৯), উপহার (১৯৭৯), মতিমহল (১৯৭৯), অরুণ বরুণ কিরণমালা, সাত ভাই চম্পা, হীরামন (১৯৭৯), দেবদাস (১৯৭৯), দুই জীবন (১৯৮৭) প্রভৃতি।
লেখিকা
বর্ণাঢ্য ও সংগ্রামী জীবন কবরীর। চলচ্চিত্র ও রাজনৈতিক জীবনে পেয়েছেন সাফল্য। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেও রয়েছে বিপুল ঘটনা-অভিজ্ঞতা। এসব নিয়ে সারাহ বেগম কবরী ২০১৭ সালে অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশ করছেন তার বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’। বইটি প্রসঙ্গে কবরী বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের অজানা কিছু কথা লিখেছি। এটা চারভাগের একভাগ। বইটি পড়ে একজন পাঠকও যদি উপকৃত হন, তবে আমার সার্থকতা। সত্যি বলতে, বই লিখতে বসে আমি কোনো কিছু আড়াল রাখিনি।’ কবরীর বইটির ভূমিকা লিখেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। ১৯৭৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কবরী অভিনীত ‘স্মৃতিটুকু থাক’ ছবিটি মুক্তি পায়। এখান থেকেই বইটির নাম নিয়েছেন কবরী। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এ অভিনেত্রীর ইচ্ছে, ভবিষ্যতে বইটির দ্বিতীয় খন্ড বের করবেন।
নির্মাতা
চলতি বছরের ১৭ মার্চ থেকে সারাহ বেগম কবরী তার পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি ‘এই তুমি সেই তুমি’র শুটিং শুরু করেন। করোনার কারণে পরে অবশ্য এ ছবির শুটিং বন্ধ রাখতে বাধ্য হন তিনি। ১৪ বছর আগে তিনি প্রথম ‘আয়না’ শিরোনামের একটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন। এটি প্রশংসিত ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের বিভিন্ন শাখায় সম্মাননা লাভ করে। এছাড়া তিনি ছোট পর্দার নাটকও নির্মাণ করেন।
গীতিকার
সফল অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখিকা ও রাজনীতিবিদ এক সময় গীতিকার হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। তার সরকারি অনুদানে নির্মিতব্য ‘এই তুমি সেই তুমি’ নামে সিনেমার মাধ্যমে গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ কবরীর। ‘তুমি সত্যি করে বলো তো’ শিরোনামের গানটিতে কণ্ঠ দেবেন সাবিনা ইয়াসমিন। আর এই কণ্ঠশিল্পী কবরীর রচিত গানটিকে দশ এ নয় দেন।
কবরীর আত্মকথা
কবরী এক সাক্ষাৎকারে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফিরে যান চলচ্চিত্র জীবনের শুরুতে। তিনি বলতে শুরু করেন, যখন চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করি, তখন আমার বয়স মাত্র ১৩ বছর। ক্লাস সিক্সে পড়ি। সুভাষ দত্ত একটা কিশোরীর ভূমিকার জন্য খুঁজে আমাকে পেয়ে যান। সাংস্কৃতিক পরিবারে মানুষ হয়েছি। মা পুঁথি পড়তেন, ভাইবোনরা নাচতেন-গাইতেন, ছোট ভাই তবলা বাজাতেন। আমি নাচ করতাম। তবে আগে অভিনয় করিনি। যখন অফার পেলাম, তখন বাবা খুবই উৎসাহিত হলেন। মা দিতে চাননি। উনি বললেন, এর পড়াশোনা নষ্ট হয়ে যাবে। পরিবার একটু রক্ষণশীল তো ছিলই। আমার মায়ের ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যায়। তিনি অনেক দূর পড়াশোনা করতে পারেননি। তাই তার খুব শখ ছিল মেয়েকে পড়াবেন। আমি সুভাষ দত্ত, ফজলে লোহানী, খান আতা, জহির রায়হান থেকে অভিনয় শিখেছি। এখন তো সে রকম শিক্ষকও নেই।
কবরী দুঃখ করে বলেন, অভিনয়ের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবশ্যই দরকার। এখন অবশ্য কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ক্রিপ্টিং, অভিনয় করায় কিন্তু আমার মনে হয় না, তাতে কিছু হয়। এখানে পর্যাপ্ত উপকরণ নেই। সে ধরনের সরকারি সহযোগিতাও পাওয়া যাচ্ছে না। কিংবা যারা জানে, তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে না। ভারতীয় চলচ্চিত্র যদি দেখি, তারা কি সব ছবি ভালো বানায়? না। তারা এখন শিল্প হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। অথচ আমাদের এফডিসিকেও বলা হয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু এখানে চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেই। সরকারিভাবে যে অনুদান দেয়, সেটা পছন্দমতো লোককে দেওয়া হয়। সেই ছবি মানুষ দেখতেও পায় না। কোথায় কোন হলে চলে, সেটা মানুষ জানতেও পারে না। বণ্টনটা পকেটস্থ করার একটা ধ্যান-ধারণা হয়ে গেছে। এখানে যে উন্নয়ন দরকার, সেটা মন্ত্রী হয় বুঝতে পারেন না বা তার ইচ্ছা নেই।
এমনিতে আমি আশাবাদী, আমি স্বপ্ন দেখি, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে দেখতে তো দিন চলে যাবে। আমার জন্য তো সময় বসে থাকবে না। আমি যদি স্বপ্ন দেখতে থাকি, বাস্তবতায় রূপ না দিই, তাহলে তো কিছুই হবে না।