বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪৩ পূর্বাহ্ন

আম রপ্তানিতে বড় বাধা নীতিমালা না থাকা ও বেশী বিমান ভাড়া

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংবাদদাতা :
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১
  • ৩৪৪ বার পঠিত

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংবাদদাতা :বাংলাদেশে আমের উৎপাদন প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কৃষিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নানামুখী উদ্যোগে বাংলাদেশে বর্তমানে
বিশে^ আম উৎপাদনে ৭ ম স্থানে। কিন্তু আম রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নেয় বাংলাদেশ। কয়েকটি চ্যালেঞ্জ থাকায়
রপ্তানিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ। আমদানী ও রপ্তানীকারকরা আম রপ্তানীর প্রধান অন্তরায় হিসেবে মনে করছেন ‘ট্রান্সপোর্ট কস্ট
বেশী ও নীতিমালা না থাকা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতিবছর দুই হাজার কোটি টাকার আড়াই লক্ষ মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয়। এ সময় কর্মযজ্ঞে
জড়িত থাকে পাঁচ লক্ষাধীক মানুষ । চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতিতে জোরালো ভূমিকা রাখে আম। গত দেড় বছরে করোনার
কারনে মানুষের আয়ে কোন প্রভাব পড়েনি আমের সাথে বিশাল জনগোষ্ঠি জড়িত থাকার কারনে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষিরসাপাতী আম পেয়েছে জিআই পন্যের স্বীকৃতি। এরপরও নানান কারনে আম রপ্তানীতে নানান
জটিলতা থাকায় পিছিয়ে পড়ছে অর্থনীতিতে অবদান রাখা আম। বাংলাদেশের আম অন্য যেকোন দেশের আমের চেয়ে স্বুস্বাদু

হলেও কার্গো খরচ বেশী হওয়া রপ্তানীতে টিকতে পারছেনা। বাংলাদেশ ছাড়া যে কোন দেশ বিমানে আম পাঠায় অর্ধেকেরও
কম খরচে।
এম.টি.বি এ্য্যাগ্রো এ্যান্ড গার্ডেন এর স্বত্ত¡াধীকারী ও আম রপ্তানীকারক মোঃ মাহতাব আলী জানান,আম রপ্তানীতে
দেশে তেমন নীতিমালা না থাকায় নিজেই হংকং য়ে সরকারের সংশিল্টস্টদের সাথে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করি এবং তাদের
সহায়তা পায়। এরপর রপ্তানীর বিষয়ে যে নিয়মাবলী পায় তা দেশে পেতে একমাস সময় চলে গেছে। তিনি আরো জানান, এটি
একটা বড় সমস্যা দেশে নীতিমালা না থাকা ও স্পস্টভাবে এক জায়গায় না থাকা ও কার্গো বিমানে ভাড়া বেশী ও বিমান
লোডারদের স্মোথলি লোড না করার জন্য আম নস্টের ঝুকি থাকে। আম রপ্তানীতে আপাতত এসব সমস্যা বড় বলে মনে
হয়েছে ।
এম.টি.বি এ্য্যাগ্রো এ্যান্ড গার্ডেন এর স্বত্ত¡াধীকারী ও আম রপ্তানীকারক মোঃ মাহতাব আলী আরো জানান হংকং এর
আম রপ্তানী নীতিমাল অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা কাউন্সিল (বিএআরসি ) এর পেস্টিসাইড এ্যানালাইটিক্যাল
ল্যাবরেটরী কীটতত্ব বিভাগে আম পরীক্ষা করিয়ে হংকং এ গত জুলাইয়ে আম সরবরাহ করি। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী
পচনশীল ফ্রেশ সবজী ফল মুল রপ্তানীকারক দেশ এই সনদ পত্র দিয়ে থাকে । রপ্তানী কৃত পন্যে ক্ষতিকারক কিছু নাই তার জন্য
এই সনদ। এই জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল ও ব্যায়বহুল গজখ ( গধীরসঁস জবংরফঁব খবাবষ ) পরীক্ষা করতে হয়। এই পরীক্ষা
করে বোঝা যায় যে ব্যবহৃত কীট নাশক বা সারের কোন প্রভাব ফসলে আছে কিনা এবং তা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক
কিনা।
সুইডেন প্রবাসী ও সুইডেনে আম আমদানীকারক একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,ভারত ও পাকিস্থান থেকে
বিমানে সুইডেন আম আসতে যে খরচ,বাংলাদেশ থেকে আসতে তার চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশী ভাড়া কার্গো বিমানে, পরিবহন
খরচ তাদের কমের কারনে তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারা যায়না,অথচ বাংলাদেশী আমের স্বাদ যেকোন দেশের চেয়ে ভাল ও
চাহিদা রয়েছে।
এ ব্যবসায়ী আরো জানান, গতকয়েক বছরের তুলনায় বর্তমান পরিবহণ ব্যয় হচ্ছে তিন গুন। অন্যদেশগুলোতে ব্যয়
কমেছে। এজন্য তাদের রপ্তানির ক্ষেত্রও বেড়েছে।
ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের আহŸায়ক ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস জানান,আম রপ্তানীতে কার্গোভাড়া কমানো এবং
রপ্তানীকারকদের প্রনোদোনা প্রদানসহ উৎপাদনকারীদে বীমার ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রোনোদোনা প্রদান করতে হবে
সরকারকে। তিনি আরো জানান রপ্তানীসহ আমের নায্য দাম ও সরবরাহে সমস্যা না থাকলে ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
বৃহত্তর রাজশাহী সমিতি,ঢাকা এর সভাপতি প্রকৌশলী মাহতাব উদ্দিন জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারতীয়
প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, মেঘালয়,মিজোরামসহ প্রতিবেশী রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীসহ আরো কয়েকটি রাস্ট্র প্রধানকে আম
উপহার দিয়েছেন। মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছে দাবী জানায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম সরবরাহের।
তিনি বলেন,আম রপ্তানীতে আরো বেশি সরকারি সহযোগিতার প্রয়োজন। রপ্তানি বাজার ও বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত
করতে আশির দশকে গার্মেন্টস শিল্পে যেমনভাবে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল ঠিক তেমনি আম রপ্তানিতে প্রণোদনা দেওয়া
জরুরী। চাঁপাইনবগঞ্জের আম রপ্তানিযোগ্য প্যাকিং নিশ্চিতকরণ, সহানীয়ভাবে সঙ্গনিরোধ সনদের ব্যবস্থা,সহনীয় ভাবে
ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের সুযোগ তৈরি করা,আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে।
পরিবহন বিমানে ভাড়ার হার সহনীয় না থাকা, আম রপ্তানির জন্য নীতিমালা না থাকা এবং ভ্যাপার ও হট ওয়াটার
ট্রিটমেন্ট সুবিধা না থাকার কারনে আম রপ্তানী পিছিয়ে পড়ছে বলে জানান ভেজিটেবুল রপ্তানী ও আমদানীকারকরা।
বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান,বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি দূতাবাসের
কর্মকর্তাদের আম মৌসুমে আম উৎপাদনকারী জেলাগুলো পরিদর্শন করার ব্যবস্থা, সরকারি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের
কর্মকর্তা প্রেরণের মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান,বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশীয় আম বাগান পরিদর্শন
করানো,আম রপ্তানি করার জন্য প্যাকেজিং সামগ্রির ওপর ভর্তুকি প্রদান, বিদেশে স¤প্রসারণ করার জন্য সরকারি পর্যায়ে
উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করেন ভেজিটেবুল রপ্তানী ও আমদানীকারকরা।
এসব সমস্যার সমাধান করা হলে আম রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদিশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনার পাশাপাশি
উৎপাদক পাবে নায্যমূল্য।

আঞ্চলিক উদ্যানতত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ শফিকুল ইসলাম জানান, আম উৎপাদনে বাংলাদেশ
প্রথম সারির দিকে থাকলেও রপ্তানিতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। কারণ আধুনিক পদ্ধতিতে আম চাষ ও উন্নত বিপণন ব্যবস্থা
গড়ে না উঠা, ট্রান্সপোর্ট কস্ট বেশি হওয়ায় আম রপ্তানি কম হচ্ছে।
আম আমদানী ও রপ্তানিকারকরা জানান, বাংলাদেশের আম যেকোন দেশের আমের চেয়ে সুস্বাদু। কিন্তু অন্য দেশের
সরকার নিজ উদ্যোগে রপ্তানিতে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। এমনকি ট্রান্সপোর্ট কস্ট এ প্রণোদনা দেয়। এতে তাদের
পণ্যর উপর খরচ কম হয়। সুলভ মূল্য বিক্রি করে। অন্যদেশের আমগুলো টেকসই। সহজেই পঁচে যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আম রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকার অনেক কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আম উৎপাদনে
কৃষির উত্তম চর্চার অভাব, রপ্তানিযোগ্য জাতের অপর্যাপ্ততা, নিরাপদ ও আন্তর্জাতিক গুনগত মানসম্পন্ন আমের জাত
নির্বাচন, বাজার যাচাই ও সৃষ্টিতে সমন্বয়ের অভাব, প্রান্তিক কৃষকদের ইনপ্রাস্ট্রাকচার ও লজিস্টিক প্রাপ্তিতে সমস্যা, উৎপাদিত
আমের সেলফ লাইফ কম, কার্গো বিমান ভাড়া বেশি, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি আমের ব্রান্ডিং ইমেজ সৃষ্টি না হওয়া,
আর্ন্তজাতিক মানের প্যাকেজিংয়ের অভাব।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি
গবেষণা ইনস্টিটিউট চাইলে চ্যালেঞ্জগুলো সমস্যা নিসরণে উদ্যোগী গ্রহণ করতে পারে বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত আমের জাতের মধ্যে হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া হাড়িভাংগা, আ¤্রপালী, ফজলী
আম উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ওমান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, কানাডা, মালয়েশিয়া,
সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, ইউরোপিয় ইউনিয়নের ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ফিন্যান্ড, গ্রিস সুইডেনে আম রপ্তানি হয়।
যার পরিমান খুবই কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিকে লাভজনক ও বাণিজ্যিক কৃষিতে রুপান্তর করতে বাংলাদেশের আম রপ্তানিতে আম
রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য নতুন গন্তব্য অনুসন্ধান,আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগীতায় টিকতে মানসম্পন্ন
উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের যথাযথ সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এরই ধারাবাহিকতায়
দেশে রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন ও রপ্তানির পরিমাণ ভবিষ্যতে কিভাবে সর্বোচ্চ মাত্রায় অর্জন সম্ভব হবে, এ ব্যাপারে
সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি।
বিশ্বের প্রধান দশটি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম (এফএও-২০১১) স্থানে থাকলেও আম
রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে কোন অবস্থানে নেয় (সিআইএ ওয়ার্ল্ডবুক-২০১১)।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, দেশে ২ লাখ ৩৫ হাজার একর জমিতে আমবাগান রয়েছে। প্রতিটি গাছে গড়ে
৭৭ কেজি করে আম উৎপাদিত হয়।
আম উৎপাদনে এগিয়ে রয়েছে ভারত। ২০১৯ সালে দেশটিতে আম উৎপাদন হয় ২৫০ লাখ মেট্রিক টন। যা বিশ^
উৎপাদনের প্রায় ৪৬ ভাগ। আম উৎপাদনে ভারতের পরেই রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, চীন, মেক্সিকো ও পাকিস্তান । সুস্বাদু এ
ফলের উৎপাদনে অস্টম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সরকারী হিসেবে বাংলাদেশের উৎপাদন ছিল ১৪ লাখ মেট্রিক টন। এর
মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতেই উৎপাদিত হয় প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার প্রধান অর্থকারী ফসল
হিসেবে পরিচিত ফলের রাজা আম।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৭,৪৬৬ হেক্টর জমি থেকে ৮,৮৯,১৭৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয় আমে প্রচুর পরিমাণে
ক্যারোটিন থাকে। তাছাড়া এই ফলে অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। কাঁচা আম ফালি বা
আমচুর, চাটনি হিসেবে খাওয়া হয়। পাকা আম থেকে জুস, আমসত্ত¡, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি তৈরি হয়। বর্তমান সরকার আম
গাছের পরিচিতি, ফলের জনপ্রিয়তা, জাতীয় সঙ্গীতে আমের স্থান এবং দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আম বাগানের নিবিড় সম্পর্ক
থাকায় আম গাছকে ১৫/১১/২০১০ জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..

© All rights reserved © 2009-2022 bddhaka.com  # গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ের বিধি মোতাবেক নিবন্ধনের জন্য আবেদিত # এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Theme Developed BY ThemesBazar.Com