চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংবাদদাতা : চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার কসবা ইউনিয়নের
গোলাবাড়ি স্টেশন বাজারের আব্দুল গনি ফিটু জাত পাত ভেদে আগলে
রেখেছেন নিখোঁজ,অসহায়,বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের। এ যেন
সমাজের অনেক বিত্তবানকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখানো।
রেলের জমিতেই বসবাস ও আ¤্রয়। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও নিখোঁজ
হওয়া সব মানুষের আ¤্রয়¯’ল এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল
উপজেলার গোলাবাড়ি স্টেশন বাজার। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অসহায়
মানুষদের অভিভাবকরা যা পারেন না তা করছেন অটো মেকানিক্স আব্দুল
গনি ফিটু।
গত এক বছরে প্রায় পৌনে দুইশ নিখোঁজ ও বুদ্ধি
প্রতিবন্ধীকে আ¤্রয়,সেবা ও চিকিৎসার পর নিজ ঠিকানায় হারিয়ে
যাওয়াদের পৌছে দিয়েছেন স্বজনদের কাছে। কোন অসহায়, নিখোঁজ,
বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীসহ শারীরিক প্রতিবন্ধীর খোঁজ পেলেই ছুটে
যান উদ্ধারে। নিজের আ¤্রয় কেন্দ্রে নিয়ে এসে বাবা-মায়ের মত সব
কিছুই করেন তাদের। চট্টগ্রামের পুলিশ কনস্টেবল শওকাত‘র মানুষের জন্য
মহৎ কাজ দেখে অনুপ্রেরণা পান তিনি।
এমন কাজে সরকার ও বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে আব্দুল গনির মত
অনেকেই উৎসাহ পাবেন এমন কাজে।
এমন মানুষ না থাকলে এতদিন প্রায় পৌনে দুইশ মানুষের মিলতোনা
আ¤্রয়।
দুই বছর আগে শুরু করেন অসহায় শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে
কাজ। তাদেরই একজন জন্ম থেকে পাঁ হারানো রেনু খাতুন। আব্দুল গনি
ফিটুর চেস্টায় কৃত্রিম পাঁ লাগিয়ে অনেক দূরের একটি কলেজে প্রথম
বর্ষে লেখাপড়া করছে রেনু খাতুন।
রেলের জমিতেই গড়ে উঠেছে ছোট বাজার ও হাট। নাম
গোলাবাড়ি স্টেশন বাজার। রেলের জমিতেই আব্দুল গনি ফিটুর বাড়ি। রেল
লাইনের এপারে স্টেশন লাগা কয়েকটি ঘরের মধ্যে তিনটি ঘর কথিত
মালিকদের ভাড়ায় থাকেন। তার একটিতে অটোসার্ভিসিং, আর
আরেকটিতে কয়েকজনের কোনমতে থাকার জন্য আশ্রয়¯’ল। আরেকটি
ভাঙ্গাচোরা তাই অব্যবহৃত। ৭০ হাজার টাকা রেলের জমিতে গড়ে তোলা
বাড়ির ঘর সংস্কারের জন্য সংগ্রহ করলেও নিখোঁজ হওয়াদের উদ্ধার, আসল
ঠিকানায় পৌছানো ও তার ছোট আ¤্রয়¯’লে রেখে খাবার দিতে কয়েক
দিনেই পুঁজি শেষ করে ফেলেন আব্দুল গনি। টাকার অভাবে সংস্কার করা
হয়নি তার নিজ বাড়ির ঘর। এ নিয়ে স্ত্রীর সাথে হয় মনোমালিন্য। তারপরও
স্ত্রী সেই অসহায়দের সময়মত খাবার ঠিকই তেরী করে দেন বলে বলেন
ফিটু।
আব্দুল গনির রেজিস্টারে ৩৪ জনের নাম পাওয়া গেল। যারা সবাই ‘
মানবিক সহায়তা স্বে”ছাসেবক টিম‘ নামে গড়া সংগঠনের সদস্য।
প্রথম দিকে সবাই এমন ভাল কাজে থাকবো বলে অঙ্গিকার করে কাজ শুরু
করেছিলেন,কিš‘ এখানে নিজেরা কিছু পাবেনা বুঝতে পেরে আব্দুল
গনি ছাড়া সবাই কেটে পড়েন।
আশ্রিতদের প্রতিজনেরই চুল,নখ কাটা,কাপড় কেঁেচে দেয়া,গোসল
করা,খাবার দেয়া,নতুন পোষাক সরবরাহ করেন তার আশ্রয়¯’লে থাকাকালীন
সময়ে। ফেসবুক ও মোবাইলে যোগোযোগ করেন কিছুটা স্বাভাবিক
হবার পর। ঠিকানা পেলে নিজ খরচেই যত দূরেই হোকনা কেন পৌছে
দেন স্বজনদের কাছে। তার আশ্রয়¯’লে দেখা গেল জামাল .জাকির ও
জুম্মনকে। জামাল ( ২৮) নরসিংদি জেলার মনহরদি উপজেলার চলাকচর
গ্রামের,তার কাছে রয়েছে ৬ মাস থেকে,
অজ্ঞাত জাকির (৩৮) রয়েছে ৫ মাস থেকে ও অজ্ঞাত শিশু জুম্মন ( ১১)
রয়েছে ৪ দিন থেকে। রবিবার ভারতের প্রদিপ নামে একজনকে নিয়ে
রবিবার পর্যন্ত তার তত্বাবধানে ছিল চারজন। তার ক্ষুদ্ধসঢ়;্র আ¤্রয়কেন্দ্রে
নিয়ে আসার পর তিনি থানায় জানিয়ে রাখেন। তার ছোট্ট
দোকানটিতে অটোরিক্স্রা খুচরা যন্ত্রাংশের চেয়ে বেশী দেখা
যায়,অপ্রকিতি¯’দের নতুন ও পরিস্কার করে রাখা পোষাক ও ছয়টি
নোটবুক ও খাতা । যেখানে রয়েছে পাওয়া ও পৌছে দেয়াদের সম্ভাব্য
নাম ঠিকানা ও মোবাইল নং । সম্ভব্য ঠিকানার জনপ্রতিনিধি ও থানা
পুলিশের কাছে সম্ভাব্য মোবাইল নম্বরে জানতে চান পাওয়াদের বিবরণ ও
ঠিকানা পাবার চেস্টা।
জানালাহীন একটি ছোট্ট ঘরে ফ্যানের নীচে শুয়ে আছে কয়েকজন।
আব্দুল গনি তাদের ডাকতেই উঠে বসে,সাবান ও পোষাক নিতে বললে
তারা নেয়,একসাথে পাশেই পুকুরে গোসল করতে যায়,সাবান দিয়ে
সবাইকে পুকুরে গোসল করিয়ে শরীর ও মাথা মুছে দেয় আব্দুল গনি।
ছোট জুম্মনকে ভেঁজা প্যান্ট পাল্টিয়ে আরেকটি প্যান্ট পরিয়ে
দেয়,সবার ভেঁজা গামছা,লুঙ্গি ও প্যান্ট কাঁচতে নামে পুকুরে। ভেঁজা
কাপড় শুকাতে দিয়ে সবাইকে চেয়ারে বসানোর পর চিরুনী করিয়ে দেয়
এবং গেঞ্জি পরিয়ে চলে যান জামালকে নিয়ে বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার
আনতে। ভাত,ডাল,শব্জির সাথে ছিল মুরগীর মাংশ। নিজ হাতে থালাই
খাবার তুলে দেয়ার পাশাপাশি জুম্মনকে নিজ হাতে খাইয়েও দি”িছল
কয়েকবার। নিজের তিন সন্তানদের জন্যও হয়তো প্রতিনিয়ত এমনটি
করেননি আব্দুল গনি। আব্দুল গনির এসব ঘটনা চোখে না দেখলে শুনে
বিশ^াস করাটাও অনেকেরই কঠিন। মানবতার জন্য সেই কঠিনতম কাজ
অবিরাম করে যা”েছন আব্দুল গনি।
¯’ানীয় বনিক সমিতির সভাপতি জিল্লার রহমান বলছিলেন আব্দুল
গনী যা করছে তা যদি প্রতি উপজেলায় একজন করে এমন কাজ করতো
তাহলে সমাজে কেউ নিখোঁজ থাকতো না,সেবাযতœহীন থাকতো
না,অপ্রকৃতি¯’রা সু¯’ হয়ে যেত। এলাকাবাসী কসিমুদ্দিন,মসিউর
রহমানসহ অনেকেই জানান আব্দুল গনি ফিটু যেভাবে এসব ব্যক্তিদের
প্রসাব-পায়খানা ও শরীর এবং নোংরা পোষাক পরিস্কার করে অনেকেই
বাবা-মা ও সন্তানদের এভাবে করা সম্ভব না। এমন কথা পরিস্কার হলো
জামাল,জাকির ও জুম্মনের প্রথম দিনের ছবি ও শনিবার দেহে চাকচিক্য
পোষাক ও সুন্দর চেহারা দেখে।
কসবা ইউনিয়ন স্বা¯’্য কেন্দ্রের উপ-সহকারী কমিউনিটি
মেডিক্যাল অফিসার আব্দুল হালিম লিমন জানান, পাশেই আব্দুল গনিকে
দেখে আসছি তিনি মানবতার কাজ করেন,এমন বিরল,আমাদের সাধ্যমত
চিকিৎসা দিয়ে থাকি,সেবা,পরিচর্যা ও গাইডলাইন থাকাসহ ও
চিকিৎসা পেলে সবাই সু¯’ হবেন। ফিরবেন নিখোঁজ ও অবহেলিতরা
আপন নীড়ে।
আব্দুল গনি ফিটু বলেন
আব্দুল গনি ফিটু যাদের চিকিৎসা দরকার তাদের চিকিৎসা
করায়,দরকার হলে রাজশাহী গিয়ে নিজ খরচ ও কারো কারো কাছ থেকে
সামান্য পাওয়া অর্থে চিকিৎসার ব্যব¯’া করি। স্বজনদের কাছে পৌছে
দিই,পোষাক ও তিনবেলা খাবার চালায়,নিজের আয় খুবই কম,অটোরিক্সা
মেকানিক্সের কাজ করি,নিজের জমি নাই,যা সামান্য আয় করি তা দিয়ে
তাদের চালায় ও নিজে চলি। কারো কাছ থেকে তেমন সহায়তা
পায়না,সরকারী কোন অনুদানও পায়না।
আব্দুল গনি বলেন,২ বছর আগে চিটাগাংয়ে ( সিআরপিসি )
এক পুলিশ সদস্য শওকত ভায়ের মানুষের প্রতি ভালবাসা ও সেবা দেয়ার
অনুপ্রেরনা থেকে এমন কাজে নেমে পড়ি। সেই পুলিশ সদস্যের
সহায়তায় আমাদের এলাকার রেনু খাতুনের কৃত্রিম পাঁ রেনুকে নিয়ে
গিয়ে লাগিয়ে আনি,রেনুকে তিন মাসের কম্পিউটার প্রশিক্ষন
প্রদান করে সিআরপি,রেনু চলাফেরা করতে পারতো না,এখন সে
নির্বিঘেœ চলাফেরা করতে পারছে,লেখাপড়া করছে নাচোলের একটি
কলেজে। রেনুর মত অসহায় হাত পাঁহীন পঞ্চাশ জনের তালিকা
রয়েছে,চেস্টা ছিল সেই পুলিশ সদস্য শওকত ভায়ের চেস্টায় একটা একটা
করে কৃত্রিম হাত-পাঁ লাগানোর ব্যব¯’া করা। করোনার কারনে সব বন্ধ
হয়ে যায়।
এরপর এক বছর থেকে অসহায় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী,মাদকাশক্ত,মানসিক
ভারসাম্যহীন, শারীরিক প্রতিবন্ধী,অপ্রকৃতি¯’ ও নিখোঁজ মানুষদের
খুঁজে খুঁজে এনে সেবাযতœ ,আ¤্রয় প্রদান,খাওয়া দাওয়া,থাকা ও
পোষাকের ব্যব¯’া করা,কারো ঠিকানা পেলে পৌছে দেয়া। এখন পর্যন্ত
১৭৫ জনকে পায়,তারমধ্যে ঠিকানা সংগ্রহ করে ৭৫ জনকে পরিবারের
কাছে পৌছে দেয়া হয়েছে। শিশু জুম্মনের পাঁয়ের নখ কাটতে কাটতে
তিনি বলেন প্রতিদিনই অন্তত ৫/৬ জন থাকে। তার আশ্রয়কেন্দ্রে ছয়
মাস ধরে থাকা আশ্রিত জামাল প্রসঙ্গে বলেন , জামালের ঠিকানা
পাওয়া গিয়েছিল,সেখানে গিয়ে দেখি তার ভায়ের
কান্নাকাটি,একারনে যে ভাইকে ফিরে পাওয়া আনন্দের চেয়ে কিভাবে
ভাইকে নিয়ে চলবে এ কস্টে,জামালের আর কেউ নাই,তার ভাইও তাকে রাখার
সামর্থ রাখেনা,অবশেষে তাকে নিয়েই ফিরে এসে এখনও রয়েছেন আমার
আ¤্রয়ে।
কয়েস আলীর মেয়ে কলেজ পড়–য়া রেনু খাতুন জানান আব্দুল গনি
ফিটু,চিটাগাং সিআরপি পুলিশ বিভাগসহ বিদেশী একটি
বেসরকারী সং¯’া তাকে সহায়তা না করলে লেখাপড়াতো দূরের কথা
চলাফেরাই করা হতোনা। বাড়ির আঙ্গিনা থেকে বাইরে বাঁশতলায় হেটে
এসে বলছিলেন এমন কথা।
আশ্রিত ও ঘরে ফেরা
আব্দুল গনির আ¤্রমে থাকা অসহায়,বাক,শারীরিক ও বুদ্ধি
প্রতিবন্ধী,নিখোঁজ হওয়া ১৭৫ জনের মধ্যে প্রায় ৭৫ জন ফিরে গেছেন
নিজ নীড়ে। আব্দুল গনি পৌছে দিয়েছেন নিজ খরচ ও স্ব উদ্যোগে। ৭৫
জনের মধ্যে রয়েছেন ঝুমা,নার্গিস,নূরজাহান,
তানিয়া,মনিরা,আশরাফুল, আজিজুর ,সেরাজুল,টিপু,
কামরুন্নাহার,তেতুল কামাল,হাবিবুল্লা,জামাল,উত্তম
কুমার,মেহেদি,সাইদুল,শফিকুল,সাব্বির গাজী,বুলবুলি ও আব্দুল
মালেকসহ ৭৫ জন। এদের কেউ কেউ ৪ দিন থেকে ৩৫ বছর যাবত পরিবার
থেকে দূরে ছিলেন।
জরুরী প্রয়োজন
এলাকাবাসী ও আব্দুল গনির চাওয়া বুদ্ধি
প্রতিবন্ধী,অপ্রকৃতি¯’ ও নিখোঁজ সব মানুষদের সেবা আ¤্রয় দিতে
হলে একটি ভাল ঘরের দরকার,তাদের ভরণপোষন,থাকা খাওয়ার জন্য বিত্তবান ও
সরকারের অনুদান জরুরী।