বিডি ঢাকা অনলাইন ডেস্ক: রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) সঙ্গে ভয়ঙ্কর জালিয়াতের চেষ্টা করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি কোম্পানী প্রায় ৮৭ কোটি টাকার এই জালিয়াতির চেষ্টা করছে। আটটি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক কেনার নামে নয়টি ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে চুক্তিপত্র সম্পাদনের নামে এই জানিয়াতির চেষ্টা করছে শিনশিন গ্লোবাল কোম্পানী লিমিডেট (Shinshin Global Co. Ltd)।
এছাড়াও তারা সে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে ব্যর্থ হয়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকা (তিন লাখ ইউএস ডলার) ক্ষতিপুরণ দাবি করে। এ নিয়ে বুধবার দুপুরে রাসিকের এ্যানেক্স প্লাজায় সংবাদ সম্মেলন জালিয়াতির চেষ্টার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করা হয়েছে। গত ২৩ ডিসেম্বর সিটি করপোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারিং এডভাইজার আশরাফুল হক এই সাধারণ ডায়রি করেন। এছাড়াও সাইবার আইনে মামলা করারও প্রস্তুতি চলছে। বিষয়টি অবহিত করে ১৫ ফেব্রুয়ারী দক্ষিন কোরিয়া দূতাবাসসহ সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। পরে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন।
লিখিত বক্তব্যে সিটি মেয়র বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন দেশের মধ্যে অন্যতম একটি সিটি করপোরেশন। মহানগরীর সকল নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, সবুজায়ন, বায়ু দূষণ কমানো, ইপিআই কার্যক্রমে জাতীয়ভাবে পরপর ১০ বার দেশসেরা হওয়াসহ নানাবিধ ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অদম্য অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতায় ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের প্রাণের মহানগরী রাজশাহীও উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, আন্তর্জাতিক একটি চক্র জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধমে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপতৎপরায় লিপ্ত হয়েছে।
মেয়র লিটন বলেন, চক্রটি কৌশলে আমার পাসপোর্ট জালিয়াতি, ভুয়া ই-মেইল আইডি ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার এবং সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তার ভূয়া নাম, পদবী ও স্বাক্ষর ব্যবহারের মাধ্যমে কোরিয়ান শিনশিন গ্লোবাল কোম্পানী নিকট থেকে আটি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক ক্রয়ে নয়টি ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেছে বলে জানতে পেরেছি। তবে তৃতীয় কোন পক্ষ না কোম্পানী নিজেই বিভিন্ন ভূয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে রাজশাহী সিটি করপোরেশনকে ফাঁসানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে, তা যথাযথ তদন্ত ও তথ্য প্রমাণ প্রাপ্তি সাপেক্ষে জানা যাবে।
মেয়র বলেন, আমার সাথে ফোনালাপ কিংবা আমার ই-মেইলে যোগাযোগ না করে ভূয়া ই-মেইলে যোগাযোগের মাধ্যমে চুক্তিপত্র সম্পাদনের বিষয়টি অবহিত করার পরও দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে কোম্পানীটির মালিক বিসি শিন একাধিকবার যোগাযোগ ও মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করায় আমার ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের গভীর অপচেষ্টা।
সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আরও বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন বাংলাদেশের একটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। সিটি করপোরেশনের কার্যাবলীর মধ্যে ফায়ার ফাইটিং সেবা অন্তর্ভূক্ত নয়। বাংলাদেশে ফায়ার ফাইটিং এর জন্য ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স নামক একটি স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ সরকারী সংস্থা রয়েছে। ফলে সিটি করপোরেশনে ফায়ার ফাইটিং ট্রাক ক্রয়ের কোন প্রশ্নই আসে না। বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিকও। বাংলাদেশে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া পিপিএ-২০০৬ ও পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী সিটি করপোরেশনৈর সকল ক্রয় কার্যক্রম সম্পাদিত হয়। যে কোন যানবাহন ক্রয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মেনে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সরবরাহকারীর নিকট থেকে ক্রয় করা হয়ে থাকে। সরাসরি বিজ্ঞপ্তি ব্যতিরেকে সরকারি অর্থের মাধ্যমে এরূপ বৃহৎ অংকের যানবাহন কোন সরবরাহকারীর নিকট থেকে ক্রয়ের সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে কোরিয়ান শিনশিন গ্লোবাল কোম্পানীর সাথে ১০ দশমিক ১২ মিলিয়ন ইউএস ডলারের সরাসরি ক্রয়চুক্তি সরকারি ক্রয় নীতিমালা পরিপন্থি ও বাস্তবসম্মত নয়।
রাসিক মেয়র বলেন, ২০১৮ সালের ১৩ জানুয়ারি শিনশিন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী রাজশাহীতে ১০০ মেঘা ওয়ার্ডের সোলার পাওয়ার প্লাল্ট নির্মাণের আগ্রহ দেখিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র বরাবর পত্র দেয়। পত্রের প্রেক্ষিতে সেই সময়ে কোম্পানীর চেয়ারম্যান বি.সি শিন রাজশাহীতে আসেন। একাধিক আলোচনার পর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সোলার পাওয়ার প্লাল্ট নির্মাণে অনাগ্রহ দেখানোয় সে সময়েই পত্র যোগাযোগসহ এ বিষয়টির সমাপ্তি ঘটে। এর প্রায় তিন বছর পর গত বছরের ১ ডিসেম্বর বি.সি শিন তার টেলিফোন নম্বর থেকে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যাডভাইজার আশরাফুল হককে ফোন করে আটটি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক ক্রয়ের বিষয়ে জানতে চান। তখন সিটি করপোরেশনের সাথে কোম্পানিটির কখনোই যোগাযোগ না হওয়ার বিষয়টি বি.সি শিনকে জানিয়ে দেয়া হয়। এরপর তিনি কয়েকটি ই-মেইল পাঠিয়ে তার কোম্পানি থেকে আটটি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক ক্রয় বিষয়ক ভুয়া ডকুমেন্ট প্রেরণ করেন।
লিখিত বক্তব্যে মেয়র লিটন আরও বলেন, সিটি করপোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যাডভাইজার আশরাফুল হকের নিকট পাঠানো ডকুমেন্ট ও পূর্বের কথিত ই-মেইলসমূহ যাচাই করে দেখা যায় যে, বি.সি শিন আটটি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক ক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় যোগাযোগ একটি ভূয়া ই-মেইল এড্রেস khzzaman_litton@yahoo.com এর সাথে করেছেন। যা আমার ইমেইল এড্রেস নয়। প্রকৃতপক্ষে, আমার ইমেইল এড্রেস khzaman_liton@yahoo.com। লক্ষনীয় যে, আমার ই-মেইল এড্রেস থেকে যোগাযোগকৃত ই-মেইল এড্রেসে একটি জেড (z) বেশি। বি.সি শিন তার কথিত অর্থ লেনদেনের কোনো পর্যায়ে তিনি আমার সাথে ফোনালাপ বা আমার প্রকৃত ই-মেইল এড্রেসে কোন ইমেইল প্রেরণ করেননি।
সংবাদ সম্মেলনে মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন জানান, গত বছরের ০৪ ডিসেম্বর তিনি আমার বরাবর কথিত যে ডিমান নোটিশ পাঠিয়েছে তার সংযুক্তি হিসেবে প্রাপ্ত নয়টি ডকুমেন্ট যাচাই-বাছাই করে আমার পাসপোর্ট জালিয়াতি ও ভূয়া ই-মেইল আইডি ব্যবহার, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তার ভূয়া নাম, পদবী ও স্বাক্ষর ব্যবহারের বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।
তিনি বলেন, বি.সি শিন-এর ডকুমেন্টে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের যে প্যাড ব্যবহার করা হয়েছে, তা করপোরেশনের নয়। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট এর যে নাম দেখানো হয়েছে, সে নামে কোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সিটি করপোরেশনের কখন কর্মরত ছিলেন না। চুক্তিতে মো: ইসলাম খান উদ্দিন নামে সিটি করপোরেশনের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার নাম, পদবী ও সীল উল্লেখ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সিটি করপোরেশনে মো: ইসলাম খান উদ্দিন নামে কোন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বর্তমানে কর্মরত নেই বা কখনো ছিলেন না। এতে প্রমান হয় কোরিয়ান কোম্পানীর পাঠানো চুক্তিপত্রটি বানোয়াট ও ভূয়া।
এছাড়া ইমেইলে (GMT+1) টাইম জোন দেখা যায়। যা বাংলাদেশ (GMT+6) বা দক্ষিণ কোরিয়া (GMT+9) এর টাইম জোন নয়। বরং GMT+1 টাইম জোন নাইজেরিয়াসহ কয়েকটি দেশের। ডকুমেন্টে প্রদত্ত ইমেইল এড্রেস ও মোবাইল নাম্বার আমার নয়। ডকুমেন্ট হিসেবে সংযুক্ত আছে পাসপোর্টের দুটি জাল পাতা। সেখানে প্রদত্ত আমার নাম, পাসপোর্ট নাম্বার, ইর্মাজেন্সী কন্টাক্ট ও অন্যান্য তথ্যাদি সঠিক নয়। পাসপোর্টে থাকা ছবিটি পাসপোর্ট সাইজের না। আমার ছবিটি পোস্টার বা ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করে পাসপোর্টে লাগানো হয়েছে। সুতরাং বি.সি শিন এর কথিত লেনদেনের দায় আমার বা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের এর উপর বর্তায় না।
মেয়র বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার হতে বাংলাদেশে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তফশিলী ব্যাংকে এল.সি খোলার মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করা হয়ে থাকে। কোরিয়ান কোম্পানীটি তাদের স্ব-ব্যাখ্যাত আবেদনপত্রে দাবী করেছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মাননীয় মেয়র মহোদয় কোরিয়ান শিনশিন গ্লোবাল কোম্পানীকে ফিলিপাইন ও যুক্তরাজ্যের জনৈক ব্যক্তিবর্গকে ৭৮,৮৯৩ ইউএস ডলার প্রদান করার নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে এই ক্রয়চুক্তিটি পর্যালোচনা করে দেখা যায় কোম্পানীটি দক্ষিণ কারিয়ায় উৎপাদিত ফায়ার ফাইটিং ট্রাক সিটি করপোরেশনকে সরবরাহ করবেন। সেক্ষেত্রে সিটি মেয়র কোম্পানীকে ফিলিপাইন ও যুক্তরাজ্যে অর্থ প্রেরণের নির্দেশনার দাবীটি হাস্যকর ও অযৌক্তিক।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায় অপতৎপরতায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে মেয়র বলেন, এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে বোয়ালিয়া মডেল থানায় জিডি করা হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা উল্লেখ করে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে বাংলাদেশ দূতাবাসে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। চক্রটির বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র-১ ও ১২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সরিফুল ইসলাম বাবু, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন, সচিব মশিউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ারিং এডভাইজার আশরাফুল হক, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইমরানুল হক প্রমুখ।