পেটের মেদ দিন দিন বাড়ছে। আতঙ্কে খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। একটু-আধটু ব্যায়ামও করেছেন। এভাবে কিছুদিন চলার পর আবার অনিয়ম। যথারীতি মেদ আগের জায়গায়।
মেদ নিয়ে যারা এমন সমস্যায় আছেন, তাদের জন্য ১০টি পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট সহায়-এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. তাসনিম জারা। এক ভিডিওতে ধাপে ধাপে তিনি বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন, যা তার ভাষায় পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হলো।
যে যে ছোট ছোট অভ্যাসগুলো আমাদের পেটে মেদ জমিয়ে তোলে, এমন ১০টি অভ্যাসের কথা আজকে আলোচনা করব। এই লিস্টের কিছু অভ্যাস আপনাকে আশ্চর্য করবে আর কিছু হয়তো আপনি আগে থেকেই জানেন। আমি প্রত্যেকটি বিষয়ের কারণ বুঝিয়ে বলে সমাধানও আলোচনা করব।
খাবার বাদ দেয়ার বিষয়ে সতর্কতা
অনেকেই সকালের নাশতা বাদ দিয়ে একবারে দুপুরে খাবার খাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এক বেলা খাবার বাদ দিলে পরবর্তীতে বেশি খাবার খাওয়া বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার প্রবণতা অনেকের ক্ষেত্রেই বেড়ে যায়। এতে ওজন বাড়ার ও মেদভুঁড়ি বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। যদি আপনার ক্ষেত্রে এমনটি হয়, তাহলে কোনো বেলার খাবার বাদ দেবেন না। যদি খাবার বাদও যায়, তখন সতর্ক থাকবেন যেন পরের বেলায় অতিভোজন বা অস্বাস্থ্যকর খাবার না খাওয়া হয়।
আনমনে খাওয়া যাবে না
টিভিতে খেলা, নাটক বা অন্য কিছু দেখতে দেখতে যদি খাওয়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে মেদভুঁড়ি জমার সম্ভাবনা থাকে। কীভাবে? সমস্যাটা টিভি, খেলা বা নাটকের না; সমস্যাটা হচ্ছে আনমনে খাওয়ার। আপনি যখন আরেকটা কাজে ব্যস্ত, আপনি কতটুকু খাচ্ছেন, সেটার দিকে সাধারণত মনোযোগ কম থাকে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাওয়া হয়ে যেতে পারে।
অনেক সময়ই টিভি দেখতে দেখতে খাওয়া আমরা ক্ষুধা লেগেছে বলে খাই না; বরং টিভি দেখতে দেখতে কিছু একটা খেতে হবে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই খাই। আবার এই খাবারগুলো অনেক সময় স্বাস্থ্যকর হয় না।
মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকা
মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের কারণে মেদভুঁড়ি জমে এবং এটা হয় কয়েকভাবে। আমরা যখন দিনের পর দিন মানসিক চাপে ভুগি, তখন আমাদের শরীরে ‘কর্টিসল’ নামের একটা হরমোন নিঃসরণ হয়। এই হরমোনটা বাড়লে অতিরিক্ত চিনি বা চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার ক্রেভিং বা প্রবল ইচ্ছা জাগতে পারে।
ওজন বা মেদভুঁড়ি বাড়াতে কর্টিসলের প্রভাব এখানেই শেষ না। আরও তিনটা কাজ সে করে। ১. শরীরের অন্যান্য জায়গায়, যেমন: পিঠ, উরু, নিতম্ব, এই সমস্ত জায়গার চেয়ে পেটের অংশে চর্বি জমতে বিশেষ সাহায্য করে কর্টিসল। এটাকে আমরা বলি সেন্ট্রাল অ্যাডিপোসিটি। ২. আরেকটা হরমোনকে বাড়িয়ে দেয়, যে হরমোনটা আমাদের বেশি করে ক্ষুধা অনুভব করায়। ৩. লেপটিন নামের এক হরমোন কমিয়ে দেয়, যেটা আমাদের পেট ভরা অনুভব করায়।
সারাংশ হলো এর ফলে পেট ভরা কম মনে হয়; ক্ষুধা বেশি লাগে। আর বেশি খেলে যে চর্বিটা হয়, সেটা পেটের অংশে জমায়। নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, পছন্দের কাজ, মেডিটেশন, প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে মানসিক চাপকে দূরে রাখবেন।
পরিমিত ঘুমে নজর
কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কম ঘুমের সাথে ওজন বেড়ে যাওয়ার এক সম্পর্ক আছে। এটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। আপনি যখন রাত জাগেন, তখন কিছু একটা ইচ্ছা করতে পারে। ঘুমিয়ে থাকলে তো এই অতিরিক্ত খাবারটা খাওয়া হতো না।
আবার রাত জেগে কাজ করার সময় আমরা যে খাবারগুলো সাধারণত খাই, সেগুলো প্রায়শই ক্ষতিকর ফ্যাট বা চিনিযুক্ত খাবার বা অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার হয়। খাবার স্বাস্থ্যকর কি না, তা নিয়ে ওই সময় অত চিন্তা আমরা সাধারণত করি না। তারপর যদি নিয়মিত ঘুম কম হয়, তখন সেটা মানসিক চাপ বা স্ট্রেস তৈরি করতে পারে। সেই স্ট্রেস আবার বিভিন্নভাবে বাড়তি ওজন এবং মেদভুঁড়ির কারণ হতে পারে।
দ্রুত খাওয়া যাবে না
আপনি যখন খাবার খাওয়া শুরু করেছেন, সে খাবার পেটে যায় এবং পেটের সাথে আপনার ব্রেইনের একটা কথাবার্তা হয়। পেট ভরেছে কি না, এটা ব্রেইনের জানতে ২০ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আপনি যদি দ্রুত খান, তাহলে বেশি খেয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। কারণ ব্রেইন হয়তো তত দ্রুত পেটের কাছ থেকে জেনে আপনাকে বলতে পারবে না যে, আপনার পেট ভরে গেছে।
সমাধান হচ্ছে ধীরে ধীরে খাবারের প্রতি মনোযোগ দিয়ে খাওয়া, যেটাকে আমরা মাইন্ডফুল ইটিং বলি। আর যদি খুব দ্রুত খেতেই হয়, তাহলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার নিয়ে সেখানেই খাওয়া শেষ করা।
বড় প্লেটে খাবার না খাওয়া
প্লেটটা তো মূল বিষয় না। মূল বিষয় হচ্ছে আপনি পরিমাণে কতটুকু খাচ্ছেন। প্লেটটা বড় হলে সাধারণত খাবার একটু বেশি পরিমাণে নেওয়া হয়। আমরা সাধারণত প্লেটে যতটুকু খাবার নিই, পুরোটাই শেষ করে উঠতে চাই। হয়তো কিছু বাকি থাকতে আমার মনে হচ্ছে পেট ভরে গেছে, কিন্তু প্লেটে যেহেতু খাবার আছে, সেই খাবারটা রেখে আমরা উঠতে চাই না। আর এভাবেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া হয়ে যায়। তাই শুরু থেকেই যদি প্লেটটা একটু আকারে ছোট হয় বা খাবার নেয়ার সময় আমরা পরিমাণটা খেয়াল রাখি, তাহলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়ার সম্ভাবনা কমবে।
সৌজন্যবোধ থেকে বেশি খাওয়া যাবে না। দাওয়াত খেতে গেলে আমরা অনেক সময় সৌজন্যবোধ থেকে বেশি খেয়ে ফেলি। প্লেটে কেউ খাবার দিয়ে দিলে সেটা শেষ করে ওঠা কর্তব্য হিসেবে ধরে নিই। আবার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হলে পেট ভরা থাকার পরও কিছু একটা অর্ডার দেয়া হয়। এই অভ্যাসগুলো ওজন বাড়াতে ও মেদভুঁড়ি জমাতে পারে।
এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত খাবার শরীরে যেসব বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা মাথায় রেখে খাবার খাওয়ার বা না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন।
দাওয়াতে আরেকটা প্রচলন হচ্ছে শেষে মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়া। এই ক্ষেত্রেও খেয়াল রাখবেন যেন অতিভোজন না হয়। পরিমিত পরিমাণে মিষ্টিজাতীয় খাবার খাবেন।
লাল চাল ও লাল আটা খাওয়া
সাদা চাল, সাদা আটা তৈরি করার সময় ফাইবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ফেলে দেয়া হয়। ফাইবার আমাদের খাবারকে আস্তে আস্তে হজম করতে সহায়তা করে। ফাইবার ফেলে দেয়ার কারণে খাবারগুলো দ্রুত হজম হয়; রক্তে সুগারের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সাদা চাল সাদা আটার মতো এমন প্রক্রিয়াজাত শস্যদানা বেশি খাওয়ার সাথে মেদভুঁড়ি সম্পর্কযুক্ত। অন্যদিকে লাল চাল বা ঢেঁকিছাঁটা চাল, অনেকে যেটাকে কুড়াকাটা চাল বলেন, তারপর লাল আটা, এমন গোটা শস্যদানা বেশি খাওয়ার সাথে মেদভুঁড়ি কম হওয়ার সম্পর্ক দেখা গেছে।
তাহলে কী করা যেতে পারে? লাল চাল বা ঢেঁকিছাঁটা চাল খাবেন। এই লাল চালের ওপরের পরতটা ফেলে দিয়েই সাদা চাল তৈরি করা হয়েছে। সাথে সাথে অনেকগুলো প্রয়োজনীয় পুষ্টি আমরা হারিয়েছি। আস্তে আস্তে লাল চাল, লাল আটা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন। প্রথমে ভালো নাও লাগতে পারে, কিন্তু এটা মেদভুঁড়ি কমাতে সাহায্য করবে এবং স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকার করবে।
লো ফ্যাট বা ফ্যাটমুক্ত খাবারের বিষয়ে সতর্কতা
লো ফ্যাট খাবারে মেদভুঁড়ি হতে পারে, এটা শুনে আপনার একটু খটকা লাগতে পারে। কারণ আমরা সাধারণত মনে করি যে, লো ফ্যাট খাবার হচ্ছে স্বাস্থ্যকর। এটা সত্য যে, লো ফ্যাট খাবার স্বাস্থ্যকর হতে পারে, তবে সব ক্ষেত্রে না। একটু ব্যাখ্যা করলেই বুঝবেন।
একটা খাবার যখন লো ফ্যাট করা হয়, তখন সেখান থেকে ফ্যাট সরিয়ে বা কমিয়ে ফেলল। এতে খাবারটা অনেকের কাছেই কম সুস্বাদু লাগে। খাবার কম সুস্বাদু হলে তো বিক্রি হবে কম।
সুস্বাদু করতে আর বিক্রি বাড়াতে তখন ওই খাবারে অতিরিক্ত চিনি যোগ করে দেয়া হয়। অতিরিক্ত চিনি অনেকে ক্যালোরি যুক্ত করে, অস্বাস্থ্যকর এবং ওজন বাড়ায়।
আপনি হয়তো ভাবছেন, লো ফ্যাট খাবার খাই, তবু কেন ওজন বাড়ে? এটা কেন হতে পারে, তা জেনে গেলেন। এখন লো ফ্যাট খাবার কেনার আগে সেখানে চিনি যোগ করা হয়েছে কি না দেখে নেবে।
হাঁটাচলা
শুয়ে বসে থাকলে যে শরীরে চর্বি জমে, এটা সবাই জানেন। তাই এইটা নিয়ে বেশি কথা না বলে সমাধান বলি।
সপ্তাহে পাঁচ দিন মাত্র ৩০ মিনিট করে দ্রুত হাঁটলেই অনেক উপকার পাবেন। রোগব্যাধির সম্ভাবনা কমবে; শরীরে চর্বির পরিমাণ কমবে।
রাতারাতি চর্বি কমার আশা করবেন না। হাঁটা চালিয়ে যাবেন। সাথে কিছু ভারোত্তোলন করতে পারলে আরও ভালো। আর অন্য কোনো ব্যায়াম আপনার জন্য উপযুক্ত হলে, সেটা তো করতেই পারেন।