মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৪ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে সব পক্ষেরই সচেতনতা দরকার : আলোচনা সভায় অভিমত ক্ষতিপূরণ দাবি বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ ৫৯৫ টাকা কেজি দরে দিনে ১ কোটি টাকার গরুর মাংস বিক্রি করেন খলিল ঢাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, নারী-শিশুসহ দগ্ধ ৭ বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, পল্লী বিদ্যুতের ৭ জন বরখাস্ত ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের কর্মসূচি স্থগিত ন্যাশনাল মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজে হামলা- ভাঙচুর, পরীক্ষা স্থগিত বরাদ্দের মধ্যেই দিবস পালন করতে হবে : জেলা প্রশাসক চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বারের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় আবদুল ওয়াহেদ নেতৃত্বাধীন প্যানেলের

আশা জাগাচ্ছে বায়ুবিদ্যুৎ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
  • ৫২ বার পঠিত

বিডি ঢাকা ডেস্ক

 

 

 

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঢেউয়ের গর্জন শুনে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে বিস্তীর্ণ মাঠে পৌঁছে আবার শোনা গেল গর্জন। তবে এই গর্জন আছড়ে পড়া ঢেউয়ের নয়, বাতাসের গর্জন। উঁচু উঁচু পিলারের ওপর বসানো পাখাগুলো বাতাসে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে সাগরের ঢেউয়ের মতোই গর্জন বাজছে কানে। এই পাখা ঘুরেই উৎপাদন হচ্ছে বিদ্যুৎ।

৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে কক্সবাজারের সদর উপজেলার খুরুশকুল গ্রামে সমুদ্র উপকূল ও বাকখালী নদীর তীরে। যতদূর চোখ যায়, দেখা মেলে পাখা ঘোরার এই দৃশ্য। লবণ চাষের মাঠ আর চোখ জোড়ানো ধানক্ষেতের মাঝে বেশ কিছুদূর পরপর স্থাপন করা বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইনগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সেখানকার শোভাবর্ধনও বাড়িয়েছে।

এক দশক আগেও অনেকের ধারণা ছিল, বাংলাদেশে বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাবনা তেমন একটা নেই। কিন্তু কক্সবাজারের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সেই ধারণা পাল্টে দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি তথা বায়ুবিদ্যুতের রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছর থেকে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সুবিধা পাচ্ছে কক্সবাজারবাসী। চীনের প্রযুক্তি, কারিগরি সহায়তা ও বিনিয়োগে পরিবেশবান্ধব এই কেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে ইউএস-ডিকে গ্রিন এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেড। এতে ইপিসি ঠিকাদার ছিল পাওয়ার চায়না, চায়না হাইড্রোপাওয়ার এবং ফুজিয়ান ইলেকট্রিক পাওয়ার নামের চীনের তিন প্রতিষ্ঠান। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১১৬ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলার। যেটি বিনিয়োগ করেছে চীনা প্রতিষ্ঠান এসপিআইসি।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল কাদের গণি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কক্সবাজারে প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে অন্তত ৫০ মেগাওয়াট। শহরের সবচেয়ে কাছের বিদ্যুৎকেন্দ্র এটি। ফলে কেন্দ্রটি দেশের জন্য বিশেষ করে কক্সবাজারবাসীর জন্য বড় আশীর্বাদ। এখানে কোনো জ্বালানির প্রয়োজন নেই। শুধু রক্ষণাবেক্ষণ খরচ লাগবে। জীবাশ্ম জ্বালানি সংকটের এ সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় বড় অবদান রাখবে। সেই সঙ্গে জ্বালানি আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হবে।’

তিনি বলেন, দেশের উপকূল এবং পাহাড়ি এলাকায় বায়ুবিদ্যুতের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করার সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা সেটি পূরণে অনেকখানি সহায়ক হবে।

কেন্দ্রটিতে ৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ২২টি উইন্ড টারবাইন স্থাপন করা হয়েছে, যার স্থাপিত ক্ষমতা ৬৬ মেগাওয়াট। বাতাসের গতিবেগের ওপর ভিত্তি করে এখান থেকে উৎপাদিত সর্বোচ্চ ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হচ্ছে। এতে ৯০ মিটার উঁচু ২২টি টাওয়ার বসানো হয়েছে। প্রতিটি টাওয়ারে রয়েছে ৬০ মিটার দীর্ঘ ৩টি ব্লেড বা পাখা। পাখাগুলো ত্রিমাত্রিক হওয়ায় বাতাস যেদিক দিয়েই প্রবাহিত হোক না কেন, তা আহরণ করতে পারে। এই পাখা ঘুরলে এর সঙ্গে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক টারবাইনও ঘোরে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।

পাওয়ার চায়নার ডেপুটি কান্ট্রি ম্যানেজার হান কুন বলেন, এই বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রে আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে প্রতি সেকেন্ডে বাতাসের গতিবেগ সর্বনিম্ন ৩ মিটার হলেই কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। তবে আদর্শ গতিবেগ হলো প্রতি সেকেন্ডে ৯ মিটার। কখনো বাতাসের গতিবেগ ২০ মিটার হলে ঝুঁকি এড়াতে কেন্দ্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে আবার গতি কমলে শুরু হবে বিদ্যুৎ উৎপাদন। তিনি বলেন, কয়লা দিয়ে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বছরে প্রায় ৪৪ হাজার ৬০০ টন কয়লা দরকার। কক্সবাজারের এই বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে আসায় ওই পরিমাণ কয়লার ব্যবহার বাংলাদেশে কমেছে। তা ছাড়া কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে পরিবেশ দূষণ হয়। পরিবেশবান্ধব বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর ফলে বছরে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার ২০০ টন ক্ষতিকর কার্বন-ডাইঅক্সাইড, ২৫ দশমিক ১৫ টন সালফার-ডাইঅক্সাইড এবং ৫০ দশমিক ৬৯ টন নাইট্রোজেন-ডাইঅক্সাইডের দূষণ কমাতে সাহায্য করবে।

বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এসপিআইসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ঝি ইয়ংহং বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব এই কেন্দ্রে বিনিয়োগ করতে পেরে আমরা সত্যিই খুবই আনন্দিত এবং গর্বিত। বাংলাদেশের মানুষের বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রটি পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিবেশবান্ধব আরও প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’

অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একসঙ্গে অনেক জায়গার দরকার হলেও বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে তুলনামূলক জায়গা লাগে অনেক কম। তা ছাড়া এতে কৃষিজমিরও তেমন ক্ষতি করে না। প্রতিটি টাওয়ার ও আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি স্থাপনে গড়ে ১৪ ডেসিমেল হিসেবে এই কেন্দ্রের জন্য সাড়ে ৭ একর জমির প্রয়োজন হয়েছে। তাও সেটি একসঙ্গে না হয়ে হয় ভিন্ন ভিন্ন স্থানে।

কক্সবাজার ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুকিত আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বছর জুড়ে ৮ হাজার ৭৬০ ঘণ্টা সময় বিবেচনায় নিলে এই কেন্দ্র থেকে অন্তত ২ হাজার ১০০ ঘণ্টা পূর্ণ ক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। অর্থাৎ প্রতিবছর কেন্দ্রটি থেকে গড়ে প্রায় ১৪ কোটি ৫৭ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ গ্রিডে দেওয়া যাবে। নানা রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কেন্দ্রটি নির্মাণের পর বাংলাদেশে বায়ুবিদ্যুৎ নিয়ে আশার একটা স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছি। ইতিমধ্যে এই কেন্দ্রের পাশেই আরও ৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যেটি সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এর বাইরে সম্ভাব্য অন্যান্য এলাকাতেও বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চিন্তা করা হচ্ছে।’

প্রকল্প ব্যবস্থাপক ঝো কিউআনশেং বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ১৮ বছরের চুক্তি করেছে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ১২ মার্কিন সেন্ট। এই কেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে তা দিয়ে গড়ে প্রায় ১ লাখ বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সক্ষম।

দূষণমুক্ত বিদ্যুৎ সেবার পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতেও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০০৫ সালে ফেনীর চরাঞ্চলে স্থাপিত হয় দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০০৭ সালে কারিগরি ত্রুটি, অব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত বাতাস না থাকায় এর কার্যক্রম বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর সংস্কার করে ২০১৪ সালে চালু হয়ে আবার।

২০০৮ সালে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় আরেকটি বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়। ১ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ বিতরণের পর বেশ কয়েক বছর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবার সেটি চালু হয়েছে। সবমিলে পিডিবির উদ্যোগে নির্মিত বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।

এক সমীক্ষার বরাত দিয়ে সরকারের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা রয়েছে, যেখানে বাতাসের বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৫ দশমিক ৭৫ থেকে ৭ দশমিক ৭৫ মিটার, যার মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..

© All rights reserved © 2009-2022 bddhaka.com  # গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ের বিধি মোতাবেক নিবন্ধনের জন্য আবেদিত # এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Theme Developed BY ThemesBazar.Com