রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৫ অপরাহ্ন

নিত্যপণ্যের বাজারে বেপরোয়া অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৪
  • ১৫ বার পঠিত

বিডি ঢাকা ডেস্ক

 

 

নিত্যপণ্যের বাজারে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠছে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। আলু, পেঁপে,   শাক, কাঁচকলা ও কুমড়া ছাড়া বেশিরভাগ সবজি কিনতে ভোক্তাকে খরচ করতে হচ্ছে ১০০ টাকার বেশি অর্থ। টমেটো ও গাজরের মতো সবজি কিনতে কেজিতে ২০০ টাকার বেশি গুনতে হচ্ছে। কাঁচা মরিচ বাজারভেদে ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি। বেড়েছে ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ডিম, মুরগি, মাছ ও মসলার দাম। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় স্বস্তি নেই বাজারে। নিত্যপণ্য কিনতেই সাধারণ মানুষের পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, কোনো কোনো পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তবে আমদানি শুল্ক কমানোর কারণে খোলা চিনি কেজিতে ২ টাকা কমেছে মাত্র। অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, আমদানিতে ১৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি কমানোর ফলে পরিশোধিত প্রতিকেজি চিনিতে ১৪ টাকার মতো দাম কমবে।

কিন্তু বাজারে সেই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ডিম, আলু ও পেঁয়াজসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য আমদানিতে যে শুল্ক ও কর ছাড়ের সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা ব্যবসায়ীরা লুটে নিচ্ছে। ভোক্তাদের বেশি দাম দিয়ে ভোগ্য ও নিত্যপণ্য কিনতে হচ্ছে। এদিকে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার শুল্ক ও কর ছাড়ের মতো বেশকিছু উদ্যোগ নিলেও সেই সুবিধা ব্যবসায়ীরা লুটে নিচ্ছেন। তবে সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, শীঘ্রই নিত্যপণ্যের দাম কমে আসবে। সরকার ইতোমধ্যে দাম কমাতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করছি বাজারে সেটির প্রতিফলন ঘটবে। এ ছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, পণ্যের দাম বাড়াতে কোনো ব্যবসায়ী দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে, দাম না কমায় ভোক্তাদের বেশি দামেই নিত্যপণ্য কিনতে হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাজার পরিদর্শন টিম রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীদের অনিয়ম দেখতে পাচ্ছে।

এ অবস্থায় অসাধু ব্যবসায়ীদের জরিমানা গুনতে হচ্ছে। কিন্তু পরিদর্শন টিম বাজার ত্যাগ করলেই ফের নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে নিত্যপণ্যের বাজারে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও পাইকারিতে ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণে খুচরা পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ১০ টাকা বেড়েছে। ডিমের বাজারে চলছে রীতিমতো নৈরাজ্য। খামার থেকে প্রতি পিস ১১ টাকায় কিনে পাইকারি আড়তেই ১৫ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এ কারণে ভোক্তা পর্যায়ে এ ডিম ১৬-১৭ টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে। ভারত থেকে আমদানির খবরে বর্তমানে একটু কমেছে ডিমের দাম। তবে ছুটির দিন শুক্রবার সকালে বাজারে গিয়ে অনেকে বেশি দাম দিয়ে ডিম কিনেছেন বলে অভিযোগ করেছেন। আর এমন পরিস্থিতির জন্য রাজধানীর ২২-২৫ জন ব্যবসায়ী দায়ী বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের কারসাজিতে ২০ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে ২৮০ কোটি টাকা লুটে  নেওয়া হয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার জন্যই মূলত এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পাইকারিতে সিন্ডিকেটের কারণে খুচরা পর্যায়ে চরম খেসারত দিচ্ছেন ভোক্তা। এ ছাড়া খুচরা বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি পেঁয়াজ কিনতে ক্রেতাসাধারণের ২০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনতে ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পেঁয়াজের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া অত্যাবশ্যকীয় পণ্য চাল নিয়ে করা হচ্ছে চালবাজি। চালের বাজার এখন স্থিতিশীল থাকলে দাম কমেনি। আগের বেড়ে যাওয়া দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে ৫৫ টাকার নিচে মোটা চাল পাওয়া যাচ্ছে না। সবজি থেকে শুরু করে আদা-রসুন, চিনির দাম বাড়িয়ে ক্রেতাকে জিম্মি করা হয়েছে।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস পার হয়েছে। পণ্যমূল্য ক্রেতাসাধারণের নাগালে আনতে এ সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। আমদানিতে শুল্ককর কমানোর পাশাপাশি বাজারে তদারকি সংস্থাগুলোর অভিযান বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে গঠন করা হয়েছে টাস্কফোর্স। তার পরও অসাধুরা থামছেন না। বাজারে অরাজকতা সামলাতে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করলেও তা কাগজে-কলমেই থেকে যাচ্ছে। বিক্রেতারা সরকারের সিদ্ধান্তকে এক প্রকার বৃদ্ধাঙ্গলি দেখাচ্ছেন। এতে বাজারে ক্রেতা সাধারণ প্রতারিত হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বাজার ব্যবস্থায় বর্তমানে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা নেই। ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর করছেন না। এমনকি অসাধুরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটছেন। মূল্য নির্ধারণ করার পর তা না মেনে বেশি দামে বিক্রি করায় ক্রেতার বাড়তি দরেই কিনতে হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে ফের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। যার চরম খেসারত দিচ্ছেন  ভোক্তা। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক করতে হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া যেসব পণ্য আমদানিতে শুল্ক ও করছাড় দেওয়া হয়েছে বাজারে সেটির প্রতিফলন ঘটছে কি না সে বিষয়ে কঠোর মনিটরিং বা তদারকি প্রয়োজন।

এদিকে বাজারে এমন অস্থিরতার নেপথ্যে ২২ ব্যবসায়ীকে দায়ী করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারা পাইকারি আড়তদার। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে রাজধানীর এ ২২ ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা ফার্ম থেকে ১১ টাকায় ডিম কিনে এনে ১৫ টাকায় আড়ত পর্যায়ে বিক্রি করেছেন। যে কারণে হঠাৎ ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ভোক্তার খুচরা পর্যায়ে ১৬-১৮ টাকায় প্রতি পিস ডিম কিনতে হয়েছে। তা ছাড়া  তেজগাঁও ডিম আড়তদার সমিতির পক্ষ থেকে এসএমএম-এর মাধ্যমে ডিমের দাম নির্ধারণ করেছে। সেই দামে পাইকাররা ডিম কিনতে বাধ্য হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল জনকণ্ঠকে বলেন, আড়তদাররাই মূলত ডিমের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এমন ২২ জন ব্যবসায়ীকে আমরা চিহ্নিত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী পাইকারি পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেকেই আমাদের অভিযানের সময় আড়ত বন্ধ করে পালিয়েছে। তবে সেই আড়ত আমরা সিলগালা করেছি। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের জবাবদিহির মধ্যে আনা হবে। কঠোর ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। যে কারণে ডিমের দাম কমতে শুরু করেছে। তিনি জানান, একই চিত্র ভোজ্যতেলের বাজারেও। পাইকারি পর্যায়ে অযৌক্তিক মুনাফা করায় খুচরায় দাম বেড়েছে। এ ছাড়া নানা অজুুহাতে ব্রয়লার মুরগির দামও বাড়ানো হয়েছে। আমরা এমন অনিয়মে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করছি। কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।

এদিকে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজির দামই কমবেশি বেড়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ সবজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার বেশি কিংবা আশপাশে। বাজারভেদে করলা, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, পটোল, ঢেঁড়শ ৯০-১০০ টাকায়, কাঁকরোল ১০০-১৩০ টাকায়, বরবটি ১৩০-১৪০ টাকায়, ধরনভেদে বেগুন ১১০-১৬০ টাকায় ও টমেটো ২৬০-২৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সবজির মধ্যে ৫০ টাকার নিচে দাম রয়েছে পেঁপের, কেজি ৫০ টাকা।  জানা যায়, বিদায়ী আওয়ামী সরকারের সময় থেকেই বাজারে এই অস্থিরতা চলছিল। ওই সরকারের ওপর মানুষের ক্ষোভের এটিও একটি কারণ।

তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর বাজার সহনীয় করতে  বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে অস্থিরতা বাড়ছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিমুনাফালোভী পুরনো সিন্ডিকেট আগের মতোই সক্রিয়। অনেক ক্ষেত্রে বেপরোয়া। আর পথে পথে পরিচয় বদলে চাঁদাবাজিও চলছে সমানতালে। পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি চাঁদাবাজ ও সিন্ডিকেটের  হোতাদের চিহ্নিত করে কঠোর হাতে দমন না করলে বাজারে স্বস্তি ফেরানো কঠিন। এদিকে, দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাজধানীর বাজারগুলোতে ইলিশের দাম আরও বেড়েছে। এক কেজি ওজনের ইলিশ কেজি দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা, ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ এবং ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..

© All rights reserved © 2009-2022 bddhaka.com  # গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ের বিধি মোতাবেক নিবন্ধনের জন্য আবেদিত # এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Theme Developed BY ThemesBazar.Com