চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংবাদদাতা : ভারতের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে হাসপাতালের শয্যা ও অক্সিজেনের সংকট।
অক্সিজেন প্রয়োজন এমন অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পেয়ে বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেকে চলে যাচ্ছেন পার্শ্ববর্তী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও নাটোর সদর হাসপাতালে।
দেশে করোনার নতুন হটস্পট হয়ে ওঠা চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে গত ঈদুল ফিতরের পর থেকে। জেলা সিভিল সার্জন জাহিদ নজরুল চৌধুরী রোববার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের জেলায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭২৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৬০০–এর মতো শনাক্ত হয়েছে গত ঈদের পর থেকে। ঈদের আগে নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ১৪ শতাংশ, সেখানে কয়েক দিনের মধ্যে বাড়তে বাড়তে ২৬ মে ৫৫ শতাংশ এবং তারপর ৬২ শতাংশে উঠেছিল। তবে পরে একটু কমেছে।
সিভিল সার্জন জানান, এ জেলায় এখন ৫৭৬ জন করোনা রোগী আছেন। তাঁদের মধ্যে জেলার তিন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২২ জন। জেলা সদর হাসপাতালে ১৯ জন, শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুজন এবং গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন চিকিৎসাধীন আছেন। এর বাইরে সদর হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন আছেন ১৬ জন। অনেক রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর শিবগঞ্জ উপজেলার রোগীদের বড় অংশ রাজশাহী মেডিকেলে চলে যাচ্ছেন, যার খোঁজ তাঁদের কাছে আসছে না।
এ জেলায় এখন পর্যন্ত করোনায় ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১৭ জন মারা গেছেন গত ১৩ মে থেকে। গত শুক্রবার চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনায় কারও মৃত্যু হয়নি বলে সিভিল সার্জন জানিয়েছেন।তবে এদিন রাজশাহী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সাতজনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের বলেরাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস জানিয়েছেন। সেখানে মারা যাওয়া বাকিদের মধ্যেদুজন রাজশাহীর, দুজন নওগাঁর এবং একজন নাটোরের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে করোনা ইউনিটের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা ডা. নাহিদ ইসলাম মুন জানান, তাঁদের ওখানে করোনা রোগীদের জন্য ১৯টি সিট আছে। সেখানে এখন ১৯ জন রোগীই ভর্তি আছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ভারতফেরত। তিনি বাদে বাকি সবাইকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। প্রতিদিনই হাসপাতালে ভর্তির মতো অনেক রোগী আসছে। কিন্তু সিট না থাকায় নতুন রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।
অক্সিজেনসংকট নিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, তাঁদের এখানে ভর্তি রোগীদেরই ঠিকমতো অক্সিজেন সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে মোট ৬০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। সেগুলোর মধ্যে ৩০টি ব্যবহার করা যায়, বাকি ৩০টি অক্সিজেন ভরে আনার জন্য পাঠাতে হয়। কিন্তু ঠিকমতো অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না। স্পেকট্রা নামের একটি কোম্পানি মানিকগঞ্জ থেকে অক্সিজেন এনে সরবরাহ করে। তারা এখন ঠিকমতো দিতে পারছে না।
স্পেকট্রার পক্ষ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও রাজশাহী ও নাটোর এলাকায় অক্সিজেন সরবরাহের দায়িত্বে আছেন মীর আখতারুল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ করে রোগী বেড়ে যাওয়ায় অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের করোনা রোগীরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হচ্ছেন। সেখানে প্রতিদিন প্রায় দেড় শ জনকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। আবার রাজশাহী মেডিকেলে নতুন রোগী ভর্তি হতে না পারায় অনেকে নাটোর সদর হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হচ্ছে। এতে সেখানেও অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় সব জায়গায়ই অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কিছুটা সময় লেগে যাচ্ছে।
তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেন জেলা সিভিল সার্জন জাহিদ নজরুলও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিট বাড়ানো দরকার হয়ে পড়েছে। সেটাকে ৫০ আসনে উন্নীত করার জন্য স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা।
অক্সিজেন ঘাটতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন বলেন, ‘উনি (ডা. নাহিদ ইসলাম) যেটা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। কয়েক দিন ধরে তাঁরা ঠিকমতো অক্সিজেন পাচ্ছেন না। এটারও একটা বন্দোবস্ত করা দরকার। তবে সদর হাসপাতালে লিন্ডে কোম্পানি যে অক্সিজেন ট্যাংক বসিয়েছে, সেটা চালু হলে সংকট কেটে যাবে।’
করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে তরল অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ট্যাংক বসিয়েছে লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড। রাজশাহী মেডিকেলে এখন তারা অক্সিজেন সরবরাহ করছে। গত ফেব্রুয়ারিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে তাদের ট্যাংক বসিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে সব কাজ শেষও হয়েছে। তবে এখনো অক্সিজেন সরবরাহ শুরু হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ) সায়কা মাজেদ প্রথম আলোকে বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে ৫ হাজার লিটারের একটি ট্যাংক বসানো হয়েছে। আগামী বুধবার থেকে সেখানে অক্সিজেন সরবরাহ শুরু করা হবে।
রাজশাহীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের মেডিসিনের এই চিকিৎসক লকডাউনের কারণে নিজের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে আটকা পড়েছেন। এখন জেলা সদরে নিজের চেম্বারে করোনা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন তিনি।
ডা. গোলাম রব্বানী রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন জেলার ঘরে ঘরে করোনা রোগী। প্রতিদিন অনেক রোগী আসছেন যাঁদের অক্সিজেন দেওয়া দরকার। কিন্তু জেলা সদর হাসপাতালে তত সিট নেই। সে কারণে অনেকেই ওই অবস্থায় বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।’
এই চিকিৎসক বলেন, গতকাল শনিবার তাঁর কাছে তিনজন রোগী এসেছিলেন। তাঁদের অক্সিজেন স্যাচুরেশনের মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৬৬, ৮৫ ও ৮০। যার ৬৬ ছিল তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি হতে বললেও সিট না থাকায় সম্ভব হয়নি। ‘অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে আমার এখানে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি অন্য কোথাও হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিই। পরে আর তাঁর কোনো খবর পাইনি।’
সুস্থ মানুষের অক্সিজেন স্যাচুরেশনের মাত্রা ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশের মধ্যে থাকে। ৯৩ বা তার নিচে নেমে গেলে অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যাগুলো শুরু হয়। এ সময় শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে যায়, বুকে ব্যথা হয় ও নিশ্বাসে সমস্যা হয়। করোনায় অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে।
মাস দুয়েক আগে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই রাজধানী দিল্লিসহ বিভিন্ন রাজ্যে হাসপাতালে সিট এবং গুরুতর রোগীদের অক্সিজেনের তীব্র ঘাটতি দেখা দেয়। অক্সিজেন সিলিন্ডারের আকুতি জানিয়ে দেওয়া পোস্টে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ভরে ওঠে।
পরে জানা যায়, ভারতের মানুষ রূপান্তরিত নতুন ধরনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় এই ধরন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এটা বেশি প্রাণঘাতী।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর সম্প্রতি বাংলাদেশে ১৩ জনের শরীরে করোনার ভারতীয় ধরন পেয়েছে। তাঁদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাতজন রয়েছেন, যাঁরা ভারত ঘুরে আসেননি।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতের বেসামাল অবস্থার আঁচ লেগেছিল প্রতিবেশী দেশ নেপালেও। চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারতের উত্তর প্রদেশের সীমান্তবর্তী নেপালের লুম্বিনি প্রদেশে ব্যাপক হারে রোগী বাড়তে থাকে। সেখানেও হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি ও অক্সিজেনের তীব্র সংকট দেখা দেয়।