ঢাকা: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বঙ্গোপসাগরে মিথেন গ্যাসের (গ্যাস হাইড্রেট) সন্ধান মিলেছে। সমুদ্রে এক গবেষণা সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার (৫ জানুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য জানান।
বঙ্গোপসাগরে গ্যাস হাইড্রেট এবং সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদের ওপর গবেষণার ফলাফল নিয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইস অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) মোহাম্মাদ খুরশেদ আলম।
প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইস অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) মোহাম্মাদ খুরশেদ আলম বলেন, ২০১১ সালে জাতিসংঘে মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণ বিষয়ক কমিশনে বাংলাদেশের পেশ করা মহীসোপানের দাবি সংবলিত সাবমিশনটি প্রস্তুতের প্রাক্কালে বাংলাদেশ সরকার ২০০৭-২০০৮ সালে বঙ্গোপসাগরে ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩ হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার এবং ২০১০ সালে একটি ডাচ প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রায় ৩ হাজার লাইন কিলোমিটার সিসমিক ও ব্যাথিম্যাট্রিক জরিপ সম্পন্ন করে। এসব জরিপে ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের ভিতরে মহীসোপানে ৬ হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্রাঞ্চলে থাকা সম্পদের বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে, যা বাপেক্স, পেট্রোবাংলা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব জরিপের তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করেই ডেস্কটপ স্টাডিটি পরিচালনা করা হয়।
ডেস্কটপ স্টাডি গ্রুপ গঠনের পর যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটনে অবস্থিত ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি সেন্টারসহ পেট্রোবাংলা, বাপেক্স এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞগণের যৌথ প্রয়াসে গত ৩ বছর নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। এমনকি কোভিড-১৯ জনিত অচলাবস্থায়ও এই স্টাডি গ্রুপ কাজ করে গেছে। ওই স্টাডিটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকৃত জলসীমায় সমুদ্রে ও তলদেশে গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে এবং এর অবস্থান, প্রকৃতি ও মজুদের ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে।
গ্যাস হাইড্রেট তথা মিথেন গ্যাস মূলতঃ উচ্চচাপ ও নিম্ন তাপমাত্রায় গঠিত জমাট বরফ আকৃতির এক ধরনের কঠিন পদার্থ, যা স্তূপীকৃত বালির ছিদ্রের ভেতরে ছড়ানো স্ফটিক আকারে অথবা কাদার তলানিতে ক্ষুদ্র পিন্ড, শিট বা রেখা আকারে বিদ্যমান থাকে। মহীসোপানের প্রান্তসীমায় ৩০০ মিটারের অধিক গভীরতায় সমুদ্রের তলদেশের নিচে গ্যাস হাইড্রেট পানি ও মাটির চাপে মিথেন বা স্ফটিক রূপে পাওয়া যায়, যা সাধারণত ৫০০ মিটার গভীরতায় স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। স্থিতিশীল গ্যাস হাইড্রেট সমৃদ্ধ এ অঞ্চলটি সমুদ্রের তলদেশ থেকে প্রায় ১০ থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে বিশেষ করে ভারতের কৃষ্ণ-গোদাভারী এবং মহানন্দা বেসিনে বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট মজুদের সম্ভাবনা বিষয়ে ভারত ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে। কৃষ্ণ-গোদাভারী এবং মহানন্দা বেসিন এলাকায় প্রতিবছর প্রায় ১-২ বিলিয়ন টন মিশ্রিত তলানি জমা হয়। ভারত ইতিমধ্যে কৃষ্ণ-গোদাভারী এবং মহানন্দা বেসিনে এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে তিনটি স্থানে কূপ খনন করেছে। মহানন্দা বেসিনে সাগরের তলদেশে ২০৫ মিটার নিচে ২৫ মিটার পুরু একটি স্তরে প্রায় ১৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এর আগে দেশের বিভিন্ন জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গ্যাস হাইড্রেটের ভলিউম এবং এই গ্যাস হাইড্রেটটিতে থাকা মিথেনের ভলিউম অনুমান করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এই সিসমিক রিমোট সেন্সিং স্টাডিটি কেবলমাত্র গ্যাস হাইড্রেটের সম্ভাব্য উপস্থিতি এবং বিতরণের একটি ইঙ্গিত দিতে পারে। সিসমিক লাইনের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র বাংলাদেশের ০.১১ থেকে ০.৬৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট সম্ভাব্য প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট জমার অনুমান পাওয়া গেছে, যা ১৭-১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের সমতুল্য। দেশের মহীসোপানের সব এলাকার পূর্ণাঙ্গ সিসমিক জরিপ সম্পন্ন করা হলে প্রকৃত মজুদ নিরূপণ করা সম্ভব হবে।
এই সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য এলাকায় প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি ও মজুদের সমূহ সম্ভাবনা আগামী শতকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়, ১ সেন্টিমিটার ৩ স্ফটিকে আনুমানিক ১৬৪ মি ৩ মিথেন গ্যাস মজুদ থাকে। মিথেন গ্যাস অন্য জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব। তবে গ্যাস-হাইড্রেট উত্তোলনের প্রযুক্তি সহজলভ্য না হওয়ায় অনেক উন্নত দেশ এখনো গ্যাস হাইড্রেট উত্তোলন শুরু করতে পারেনি। আমরা আশা করছি, অচিরেই এই প্রযুক্তি সহজলভ্য হবে এবং আমরা বিভিন্ন উন্নত দেশের কাছ থেকে প্রযুক্তি নিয়ে গ্যাস হাইড্রেট উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব ।