অনলাইন নিউজ : বাঙালির জীবনে আগস্ট শোকের মাস। বাঙালি জাতির জীবনে নিষ্ঠুরতম কলঙ্কিত দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এই দিন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এর ২৯ বছর পর ঘাতকদের নিকৃষ্টতম ও ঘৃণ্যরূপ আবারও দেখতে পায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। এদিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী এক বিশাল জনসমাবেশের ডাক দেয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য শেষ করা মাত্রই তাকে ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে মুহুর্মুহু গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এতে মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী নিহত হন। গুরুতর আহত হন আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী। রক্তগঙ্গা বয়ে যায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে।
এ প্রশ্ন সবার মনে জাগাই স্বাভাবিক, কেন এই হামলা করা হয়েছিল? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা আসলে কী? ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল মূলত বাংলাদেশের ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত, বাংলাদেশের প্রগতিশীল শক্তির ওপর আঘাত, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির ওপর নির্মম ও নিষ্ঠুর আঘাত এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী মানবিক শক্তির ওপর চরম আঘাত।
সেদিন এই বর্বর হামলার পর বিএনপিপন্থি চিকিৎসকরা আহতদের জীবন রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেননি। তা অত্যন্ত নির্মম ও নিন্দনীয়। তবে সেদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসীসহ প্রগতিশীল মনের অধিকারী চিকিৎসকরা পেশাগত ও মানবিক দিক বিবেচনায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটে গিয়ে আহতদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছেন। সেদিন এ হামলার খবর পাওয়া মাত্রই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও প্রয়াত অধ্যাপক ডা. এএসএম জাকারিয়া স্বপন, আমিসহ বেশ কয়েক চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে যে নিষ্ঠুর ও নির্মম ভয়াবহ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছি, তা নিজের কাছেই দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট ও রাজনৈতিক প্রধান বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করা। হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ। এ হামলার সঙ্গে বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান, সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জামায়াতে ইসলামের নেতা ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, এমনকি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কোনো কোনো কর্মকর্তা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। পরবর্তী সময়ে তদন্তের মাধ্যমে তা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। আওয়ামী লীগের অন্যতম নীতি ও আদর্শ এবং বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান চার নীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতাকে জঙ্গিদের কাছে ইসলামবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে আওয়ামী নেতাদের ইসলামের শক্র হিসেবে অপব্যাখ্যা দেওয়া হয়। ধর্মকে পুঁজি করে জঙ্গিদের বিভ্রান্ত করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের হত্যা করতে জঙ্গিদের উৎসাহিত করা হয়। আসল কথা হলো, এ হামলার উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশে প্রগতিশীল ধারার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার মাধ্যমে পাকিস্তানি মৌলবাদী ধারায় বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করা। এর মানে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্ট করতেই এ হামলা চালানো হয়েছিল। এই হামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার দায় এড়াতে পারেন না। তিনি সংসদে হাস্যরস করে মন্তব্য করেছিলেন, ‘কে তাকে (শেখ হাসিনা) হত্যা করতে চায়?’ আরও বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা তার নিজের ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে জনসভায় গ্রেনেড নিয়ে এসেছিলেন।’ ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর ও বর্বর হামলা নিয়ে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আগস্ট মানেই আমাদের জন্য এক অশনিসংকেত। ২৪ নেতাকর্মী ওই গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছেন। আমি এখনো বেঁচে আছি। হামলায় যে গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়, সেটি যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহার হয়। আর ওই গ্রেনেডই একটি রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে ব্যবহার করা হলো! আমি কখনো ভীত ছিলাম না। গ্রেনেড হামলার সময় নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে আমাকে রক্ষা করেছিলেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন অসীম সাহস ও সীমাহীন ধৈর্য্যরে সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। বারবার মৃত্যুর মুখে পড়েও তিনি দেশের জন্য কাজ করা থেকে পিছপা হননি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই জননেত্রী শেখ হাসিনাও একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে মাথা নত করতে জানেন না। সেদিনের বিরোধীদলীয় নেতা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোককে শক্তিতে পরিণত করে বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলায় করেছিলেন বলেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার রায় পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৪৯ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ৪১ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের এ আবেদন অত্যন্ত যৌক্তিক বলেই মনে করি। তবে এই হামলার ঘটনায় করা মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও বিএনপি নেতা হারিস চৌধুরীসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে। এখন প্রয়োজন এই রায় দ্রুত বাস্তবায়ন করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। এ জন্য বিচারের বাকি ধাপগুলো আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হতে হবে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় যারা আহত হয়েছেন, অনেকে হাত-পা হারিয়েছেন, অনেকে শরীরে গ্রেনেডের স্পিন্টার নিয়ে দুর্বিষহ যন্ত্রণাকাতর জীবন পার করছেন। অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এসব আহত ব্যক্তি কিছুটা হলেও শান্তি পাবেন, শান্তি পাবে নিহতদের আত্মা। একই সঙ্গে দেশ ও বিশ্ববাসীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন। কারণ এই ধরনের বর্বর ও নিষ্ঠুর হামলা বাংলাদেশসহ বিশ্ব আর দেখতে চায় না। যে হামলায় ২৪ জন নিহত হলেন, শত শত মানুষের শরীর ক্ষতবিক্ষত হলো, এর পরও যদি অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না করা যায় তা হলে এসব অপরাধী আবারও জঘন্যতম পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে। আমরা আর এই ধরনের জঘন্যতম হামলা দেখতে চাই না। অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি কার্যকর হোক, ওই কামনা করে এই হামলায় নিহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং আহতরা দ্রুত আরোগ্য ও সুস্থ জীবন লাভ করুন।
২১ আগস্টের হামলা আমার বিবেচনায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনারই বর্ধিতাংশ। এ হামলার মাধ্যমে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার মাধ্যমে এ দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। তবে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র এখনো থামেনি। আগামীতে জাতীয় নির্বাচন। ওই নির্বাচন ঘিরে তারা আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। শুধু দেশের মধ্যে নয়, বিদেশে থেকেও অনেকে ষড়যন্ত্র করছে। এর পরও বলবÑ যেমন করে সব ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশল মোকাবিলা করে বাংলার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, তেমনিভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সব মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ভোটের ময়দানে স্বাধীনতাবিরোধীদের পরাজিত করার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীদের রুখে দিয়ে বাংলার বিজয় এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই ষড়যন্ত্রকারীরা আর ২১ আগস্টের মতো নির্মম ও নিষ্ঠুর ঘটনার পুনরাবৃত্তি করার দুঃসাহস পাবে না। এ ছাড়া বাঙালিসহ বিশ্ববাসীকেও এই ধরনের হিংস্র ঘটনাকে আর প্রত্যক্ষ করতে হবে না। পরিশেষে মানবতা রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় দ্রুত কার্যকর করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
লেখক : ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ,অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ এবং কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়