বিডি ঢাকা ডেস্ক
দেশে ভোজ্যতেলের প্রায় ৯০ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে মূলত সয়াবিন ও পামঅয়েলই বেশি আমদানি হয়। দেশে বর্তমানে ভোজ্যতেলের বাজারে ১১টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ্যে টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপ আমদানি করা ভোজ্যতেলের বাজারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে প্রায় ২৫ লাখ সাত হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি করা হয়। এর ৮০ শতাংশই এই চার প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। মাত্র ১০ বছর আগে এই চার প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় এক চতুর্থাংশ পূরণ করত। বাজারে তাদের সম্মিলিত অংশীদারত্ব এখন বেড়ে তিনগুণ হয়েছে।
দেশে ভোজ্যতেলের বেশিরভাগ যোগান আসে আমদানি করা সয়াবিন ও পামঅয়েল থেকে। বাকিটা সরিষা, সানফ্লাওয়ার অয়েল, রাইস ব্র্যান অয়েলসহ অন্যান্য উৎস থেকে আসে। এই বিকল্পগুলো থেকে সম্মিলিতভাবে বছরজুড়ে তেল পাওয়া যায় প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন। গত ২ বছর দেশে সরিষার তেলের উৎপাদন দুইগুণ বেড়েছে। সরিষা ও সয়াবিন তেলের দাম প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তারা সরিষা তেল ব্যবহারে বেশি আগ্রহী হচ্ছে।
গত এক দশকে দেশে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক তৃতীয়াংশ কমেছে। বিশ্ববাজারে দামের অস্থিতিশীলতা ও সরকারের নীতির কারণে অনেকে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারেননি। ২০০৮ ও ২০১২ সালে বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের দামের অস্থিরতার কারণে অনেক আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীর ব্যাপক ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীরা জানান, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমদানি খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রিতে বাধ্য করলে সমস্যার শুরু হয়। ফলে ৩২টি দেশীয় ভোজ্যতেল প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টিই বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে নূরজাহান গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, ইলিয়াছ ব্রাদার্স ও মোস্তফা গ্রুপসহ অর্ধ ডজনেরও বেশি প্রধান ভোজ্যতেল প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই শিল্পে বিপর্যয় দেখা দেয়। ঋণখেলাপি ও অন্যান্য কারণে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করলেও অতিরিক্ত মুনাফার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন টি কে গ্রুপের সিনিয়র বিপণন সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ নেই। সরকারের সংস্থাগুলো সার্বক্ষণিক বাজার নজরদারিতে রাখছে। সরকারি নীতির কারণে অনেক বড় প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, আমরা খোলা বাজার থেকে তেল কিনি। সেখানে সকালে এক দাম এবং বিকেলে আরেক দাম। কিন্তু নানা সময় সরকার আমাদের নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করে। এর ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেলের ব্যবসা থেকে সরে গেছে।
ভোজ্যতেলের বাজারে টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের বড় ভূমিকা আছে। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের সরে যাওয়ার সুযোগে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অবস্থান শক্ত করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (বিইওএল), বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস, স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস, সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ, গ্লোব, ডেল্টা এগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠান বাজারে এলেও তারা এখনও বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজার মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। শীর্ষ ব্যবসায়ীরা পণ্যের দামকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন যা ক্রেতাদের স্বার্থকে প্রভাবিত করে।
ক্যাব সভাপতির মতে, সব প্রতিষ্ঠান বাজারে অংশীদারত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করলে ক্রেতারাও উপকৃত হবেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে ক্রেতার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে সরকারের ভূমিকা জরুরি।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম বর্তমানে ১৭০ থেকে ১৭২ টাকা। আর পাম তেলের লিটারপ্রতি দাম ১৬২-১৬৩ টাকা। সেখানে বাজারে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৬৫-১৬৭ টাকা। গত এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম ১১ শতাংশ ও পাম তেলের দাম সাড়ে ১১ শতাংশ বেড়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় দেশেও পণ্যটির দাম বেড়েছে। ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয় ২০২১ সাল থেকে থেকে। ২০২২ ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায় বিশ্বাবাজারে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২১ সালে গড়ে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ৩৮৫ ডলার দরে। ২০২২ সালে প্রতি টনের গড় দাম ছিল ১ হাজার ৬৬৭ ডলারে। চলতি বছরের অক্টোবরে টন প্রতি সয়াবিন তেলের দাম দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৫ ডলার। একইভাবে ২০২১ সালে পাম তেলের গড় দাম ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ১৩১ ডলার। ২০২২ সালে একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে টনপ্রতি ১ হাজার ২৭৬ ডলার। চলতি বছরের অক্টোবরে টনপ্রতি পাম তেলের মূল্য দাঁড়িয়েছে হয়েছে ১ হাজার ৭৭ ডলার।
গত দুই দশকে দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৩০ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, পাম ও সয়াবিন তেল পরিশোধিত ও অপরিশোধিত আকারে আমদানি হয়। অপরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করা সয়াবিন তেল স্থানীয়ভাবে পরিশোধনের পর বাজারজাত করা হয়। তবে দেশের বাজারে ব্যবহার ও আমদানি বেশি হয় প্রধানত পরিশোধিত পাম অয়েল। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশ থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়। আর ১৩ লাখ টন পাম তেল আমদানির ৯০ শতাংশই আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাকি ১০ শতাংশ আমদানি হয় মালয়েশিয়া থেকে।