মুফদি আহমেদ : রমজান মুমিনের জন্য আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে এক সেরা উপহার। আল্লাহ পাকের নৈকট্য হাসিলে অন্যতম মাধ্যম হলো এই সিয়াম। সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে বান্দা তার অতীতের ভুল-ভ্রান্তিতে মাগফিরাত লাভ, অশেষ পুণ্য হাসিল এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মধ্য দিয়ে পুরস্কার হিসেবে চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাত লাভ করে। ইসলামের দ্বিতীয় হিজরিতে পবিত্র রমজানের রোজা হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়েছে। একজন মুমিনকে আত্মশুদ্ধি অর্জন করে পরিপূর্ণ সুন্দর একটি জীবন গঠনে পবিত্র সিয়াম বিরাট ভূমিকা পালন করে। তাই মুসলিম উম্মাহর কাছে সিয়ামের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম।
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, আমার উম্মতকে রমজান মাসে পাঁচটি জিনিস দান করা হয়েছে, যা আমার আগে কোনো নবীকে দান করা হয়নি। প্রথমত, রমজান মাসের প্রথম রাত যখন আসে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। আর যার ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়ে তাকে তিনি কখনও শাস্তি দেবেন না। দ্বিতীয়ত, তাদের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশকের সুবাসের চেয়েও উত্তম। তৃতীয়ত, ফেরেশতারা তাদের জন্য প্রত্যেক দিন ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। চতুর্থত, আল্লাহ তায়ালা জান্নাতকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি আমার বান্দাদের জন্য তৈরি হও এবং সুসজ্জিত হও। শিগগিরই তারা দুনিয়ার ক্লান্তি থেকে আমার ঘরে ও আমার সম্মানে স্বস্তি চাইবে। পঞ্চম, যখন শেষ রাত আসে তখন তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়। একজন জিজ্ঞেস করল, এটা কি কদরের রাতে? তিনি বললেন, না। তুমি কি মজদুরদের দেখনি যে, তারা যখন কাজ থেকে অবসর পায়, তখন তাদের মজুরি পুরোপুরি প্রদান করা হয়? (কানযুল উম্মাল)
রমজান মাস অত্যন্ত মহিমান্বিত মাস। কারণ এ মাসেই পবিত্র কোরআন মাজিদ নাজিল হয়েছে। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘রমজান মাস এমন এক মাস, এ মাসেই কোরআন নাজিল হয়েছে, যা সমগ্র মানবজাতির জন্য দিশারি, সত্যপথের স্পষ্ট পথনির্দেশকারী এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণকারী।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)। হাদিসে এসেছে, ‘রোজা হচ্ছে জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষার ঢালস্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারও রোজার দিন আসে, সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়, সে যেন তাকে বলে দেয়, আমি একজন রোজাদার।’ (বুখারি : ১৮৯৪)। দুঃখজনক বিষয়, অনেক মানুষ রোজার মর্যাদা বুঝতে পারে না। বিভিন্নভাবে কলুষিত করে পবিত্র এ মাস।
কিছু মানুষ যেন রোজা এলে অন্য মানুষ হয়ে যায়। যেখানে আখেরাতের প্রতিযোগিতায় মনোনিবেশ করার কথা, সেখানে তারা লিপ্ত হয়ে পড়ে দুনিয়ার প্রতিযোগিতায়। রমজানে ব্যবসা করা নিষিদ্ধ নয়। তবে এমনভাবে মগ্ন হয়ে পড়া যেন এ মাস ব্যবসারই জন্য এসেছে- এটা রমজানের নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশেষত ঈদকে কেন্দ্র করে রমজানে যে অবস্থা সমাজে দেখা যায়, তা খুবই বেদনাদায়ক। অনেকে কেনাকাটার পরিবর্তে মার্কেটগুলো পরিদর্শনে মগ্ন, না আছে ফরজ নামাজের জামাতে উপস্থিতি, না তারাবির গুরুত্ব। তেলাওয়াত, তাসবি, দোয়া ও রোনাজারিও পরিত্যাজ্য। এরপর নগ্নতা ও নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণসহ অন্য হারাম কাজগুলো তো রয়েছেই, যেগুলো আল্লাহর অভিশাপ ডেকে আনে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য ও কেনাকাটায় এত মগ্ন হওয়া উচিত নয় যে, নামাজের জামাত ও তারাবি ছুটে যায়। আর ব্যবসায় ধোঁকাবাজি, অহেতুক মূল্যবৃদ্ধি ও প্রতারণা এবং সুদ ও জুয়াসহ অন্য সব হারাম কার্যকলাপ থেকে সারা বছরই বেঁচে থাকা ফরজ, রমজান মাসে এর অপরিহার্যতা আরও বেড়ে যায়। কেননা বরকতপূর্ণ সময়ের গুনাহও আরও সর্বগ্রাসী হয়ে থাকে।
পার্থিবভাবে লাভবান হওয়ার জন্য সারা বছর তো পড়ে আছে। এ মাসে অল্পমূল্যে পণ্য বিক্রি করা, দান-সদকা করা, মানুষকে ইফতারি খাওয়ানো ও সাহায্য করা এসব কাজে মনোনিবেশ করা উচিত। সৎ কাজের প্রতিদান বেড়ে যাওয়ার মাস এই পবিত্র রমজান। প্রত্যেকটা আমলের প্রতিদান বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে কোনো একটি নফল ইবাদত করল, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করল। আর রমজানে যে ব্যক্তি একটি ফরজ আদায় করল, সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায় করল।’ (সহিহ ইবনে খুজায়মা)
সিয়াম এমন একটি ইবাদত যার পুরস্কার আল্লাহ পাক নিজ হাতে দেবেন বলে ঘোষণা করেন। প্রিয় নবীজি (সা.) হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রোজা আমারই জন্য। আমি নিজে এর প্রতিদান দেব। আমার বান্দা আমার জন্য পানাহার ছেড়ে দেয়, কামনা-বাসনা ছেড়ে দেয়। রোজাদারের জন্য দুটি খুশি। একটি খুশি ইফতারের সময়। আরেকটি খুশি আমার সঙ্গে তার সাক্ষাতের সময়। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের সুগন্ধের চেয়েও উত্তম।’ (বুখারি : ৭৪৯২)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে এক দিন সিয়াম পালন করবে, তায়ালা তার ও জাহান্নামের মাঝে একটি পরিখা তৈরি করে দেন, যা আকাশ ও জমিনের দূরত্বের মতো।’ (তিরমিজি : ১৬২৪)
সিয়াম পালন এমন একটি ইবাদত যার পুরস্কার রোজাদার ছাড়া অন্য কেউ লাভ করতে পারবে না। সহিহ বুখারিতে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ পাকের প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে একটি ফটক আছে। তার নাম রাইয়্যান। কেয়ামতের দিন সিয়াম পালনকারীরা সেই ফটক দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অন্য কেউ সেই ফটক দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে : সিয়াম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা উঠবে।
তারা ছাড়া অন্য কেউ যাবে না। যখন তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন রাইয়্যান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হবে। সুতরাং আর কেউ এ ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি: ১৮৯৬)। প্রকৃতপক্ষে সিয়াম হচ্ছে অতীতের ভুল-ভ্রান্তিগুলো সংশোধন করে আত্মশুদ্ধি অর্জন করা আর সেমতে জীবনকে পরিচালনা করে আল্লাহ পাককে খুশি করে পুরস্কার হিসেবে চির সুখময় জান্নাত লাভ করা।
এ জাতীয় আরো খবর..