বিডি ঢাকা ডেস্ক
বিশাল বঙ্গোপসাগরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এ রাষ্ট্রের উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পূর্বে আসাম ও ত্রিপুরা, পশ্চিমে আসাম ও মেঘালয় রাজ্য আর দক্ষিণে নীল সমুদ্র বঙ্গোপসাগর। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি দীর্ঘ ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেয় দেশের নেতৃত্ব।
প্রায় দুশ বছর ব্রিটিশশাসিত আর চব্বিশ বছর পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা নিপীড়িত-বঞ্চিত রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু এ ভগ্নপ্রায় ছোট দেশটির পুনর্গঠনের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। শিল্পকারখানাবিহীন কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের তখন নেই অর্থনৈতিক অবকাঠামো। একদিকে দারিদ্র্য, কর্মসংস্থানের স্বল্পতা, খাদ্য সংকট; অন্যদিকে বিশ্বের অন্যসব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রত্যাশা, কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে তাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু করা। এ কণ্টকবিস্তীর্ণ পথে চলতে চলতেই বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ একদিন নিশ্চিত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র হিসাবে পরিগণিত হবে।
স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি-এ তিনের মধ্যে ব্যবধান অনেক; কিন্তু পথচলা শুরু না করলে যেমন গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না, তেমনই স্বপ্ন না দেখলে লক্ষ্যও অর্জিত হয় না। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু তখনই দেশের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত বিশাল সমুদ্রের জলসীমা নিয়ে ভেবেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সংসদে উত্থাপিত হয় ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট’। এ অ্যাক্টেই প্রথম গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের কন্টিগিউয়াস জোন, ইকোনমিক জোন, কনজারভেশন জোন, কন্টিনেন্টাল শেলফ ও টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। একই সঙ্গে এসব নির্ধারিত এলাকায় বেআইনি অনুপ্রবেশ ও অননুমোদিত তৎপরতার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উল্লেখও এ বিলে করা হয়। সংসদে উত্থাপিত বিলের ওপর যথারীতি আলোচনা ও মতামত গ্রহণের পর ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পাশ হয় ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’।
১৯৭১-এ স্বাধীনতা লাভের পর স্বভাবতই একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরে আঞ্চলিক জলসীমা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মূলত সমুদ্রসম্পদ আহরণ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নের জন্যই এ জলসীমা নির্ধারণ করা অপরিহার্য ছিল। সদ্য স্বাধীন একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সমুদ্রসম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনাও একান্ত জরুরি ছিল।
১৯৭২ সালে গৃহীত আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৩(২) এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সংসদকে টেরিটোরিয়াল ওয়াটার এবং কন্টিনেন্টাল শেলফ নির্ধারণ সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়। আর এ ক্ষমতাবলেই তৎকালীন সংসদ ১৯৭৪ সালে ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ পাশ করে।
এ আইনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো-এতে টেরিটোরিয়াল ওয়াটার, কন্টিগিউয়াস জোন, ইকোনমিক জোন, কনজারভেশন জোন এবং কন্টিনেন্টাল শেলফকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সামগ্রিক দূষণ কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে। সব শেষে এ আইনের বাস্তবায়নের জন্য সরকার কর্তৃক কোনো আইন লঙ্ঘিত হলে সেটার শাস্তি কী হবে, সেই বিধানও রাখা হয়েছে।
‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’-এর অনুচ্ছেদ (৩) অনুসারে সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সমুদ্রে বাংলাদেশের জলসীমা নির্ধারণ করতে পারবে এবং ওই জলসীমার উপরিস্থ আকাশ সীমানায় দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা বিরাজমান থাকবে। এ জলসীমার ভেতরে কোনো বিদেশি জাহাজ ‘ইনোসেন্ট প্যাসেজে’র অধিকার ব্যতীত প্রবেশ করতে পারবে না। উল্লেখ্য, ‘ইনোসেন্ট প্যাসেজ’ হলো এমন একটি অধিকার, যে অধিকার বলে কোনো বিদেশি জাহাজ অপর একটি দেশের জলসীমার ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এ প্রবেশের কারণে ওই দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
টেরিটোরিয়াল ওয়াটার থেকে গভীর সমুদ্রে অগ্রবর্তী অংশকে বলা হয় কন্টিগিউয়াস জোন। দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর অনুচ্ছেদ-৪-এর মাধ্যমে সমুদ্রের জলরাশির এ অংশে দেশের নিরাপত্তা, অভিবাসন, কাস্টমস ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার্থে যে কোনো ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার সরকারকে দেওয়া হয়েছে।
আইনের ৫নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ সরকারকে জলসীমা থেকে গভীর সমুদ্রে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত এলাকা ইকোনমিক জোন হিসাবে ঘোষণা করার অধিকার দিয়েছে। ঘোষিত ও নির্ধারিত এ অর্থনৈতিক সীমানার মধ্যে অবস্থিত সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর (Both Living and Non Living) রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার থাকবে।
আইনের ৬নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সমুদ্রের জীবসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য জলসীমাসংলগ্ন এলাকাতে সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করার অধিকার সরকারকে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নির্ধারিত সংরক্ষিত এলাকায় সমুদ্রসম্পদকে ক্ষতি বা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সব ধরনের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকারও সরকারের রয়েছে।
আইনের ৭নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপত্যকাসংলগ্ন সাবমেরিন এরিয়ার সি বেড, সাবসয়েল, জলসীমা পরবর্তী সীমা থেকে কন্টিনেন্টাল মার্জিন পর্যন্ত এলাকা কন্টিনেন্টাল শেলফ হিসাবে পরিগণিত হবে। এ কন্টিনেন্টাল শেলফ্ এলাকার সব খনিজসম্পদ, জীবসম্পদের ওপর বাংলাদেশের অধিকার রয়েছে। এসব সম্পদকে যে কোনো ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করতে পারবে।
আইনের ৯নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক, কোনো বিধান লঙ্ঘিত হলে, শাস্তির বিধানসংবলিত রুল তৈরির অধিকার বাংলাদেশ সরকারের রয়েছে। এ রুলের মাধ্যমে আইনের কোনো বিধান কারও মাধ্যমে লঙ্ঘিত হলে তাকে সর্বোচ্চ ১ (এক) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা (যা ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে) অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।
দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর উল্লিখিত বিধানগুলো পর্যালোচনাসাপেক্ষে বলা যায়, বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির ওপর নির্ধারিত কিছু সীমানাসংবলিত অঞ্চলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে। ১৯৭১-এ দেশকে স্বাধীন করে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জলসীমা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুভব করতে পেরেছিলেন। আজ এরই ধারাবাহিকতায় আমরা সমুদ্র জয় করে এর বিশাল জলরাশি থেকে সম্পদ আহরণ করছি।