সোমবার, ০৩ মার্চ ২০২৫, ১০:৫০ অপরাহ্ন

রোজার বাজার: চাহিদার স্বাভাবিক প্রভাব নাকি বাজার কারসাজি?

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২ মার্চ, ২০২৫
  • ৩ বার পঠিত

বিডি ঢাকা ডেস্ক

 

 

 

প্রতিবছর রমজান এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। ২০২৫ সালও এর ব্যতিক্রম নয়। চাল, ভোজ্যতেল, ছোলা, খেজুর ও ডিমের মতো পণ্যের দাম ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে।

রোজার আগমনের অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকেই বাজারে বাড়তি চাপ দেখা যায়। ভোক্তারা আগেভাগেই প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য বাজারমুখী হন। এতে সরবরাহ কমে গিয়ে দাম আরও বাড়ার প্রবণতা তৈরি হয়।

বছরের পর বছর একই চিত্র!

২০২২ সালে রমজানের এক সপ্তাহ আগে থেকেই অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ২০২৩ সালে কিছু পণ্যের দাম কমলেও অন্যগুলো বেড়েছিল। ২০২৪ সালে বেশিরভাগ পণ্যের দাম তুলনামূলক কম ছিল।
কিন্তু ২০২৫ সালে?

রমজানের আগের সপ্তাহেই পাঁচটি প্রধান পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় বেড়ে গেছে, যদিও সয়াবিন তেল, ছোলা ও খেজুরের আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিক নাকি কারসাজি?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দুই কারণেই ঘটে। একদিকে, চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজার স্বাভাবিকভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখায়, অন্যদিকে, সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা, বাজার কারসাজি এবং নীতিনির্ধারণী দুর্বলতার কারণে ভোক্তাদের ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে। ২০২২ সালের পর থেকে টাকার মান ৩০ শতাংশের বেশি কমে গেছে, ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

বিশ্ববাজারে পাম ও সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার কারণেও প্রভাব পড়েছে। তবে এটিই মূল কারণ নয়।

পর্দার আড়ালের কারসাজি!

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এটি এক ধরনের “খেলা” যা ব্যবসায়ীরা চালান। চাহিদা বৃদ্ধি পেলেই অনেক ব্যবসায়ী সুযোগ নিয়ে বেশি মুনাফা করতে চান। যেহেতু বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল, তাই তাদের ঠেকানোর কেউ থাকে না। আরেকটি বড় সমস্যা হলো কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ।

ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আবুল হাশেম বলেন, চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো বাজারগুলো মাত্র চার-পাঁচটি বড় কোম্পানির হাতে। তারা যদি আমদানি কমিয়ে দেয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সরবরাহ সংকট তৈরি হয় এবং দাম বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, “আমরা এখনো ১০ বছর আগের চাহিদার তথ্য ব্যবহার করছি, যদিও জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে। যদি প্রকৃত চাহিদার হিসাবই জানা না থাকে, তাহলে সরবরাহ ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করবো কীভাবে?”

খুচরা ব্যবসায়ীদের ভূমিকা

চাহিদা বেড়ে গেলে অনেক খুচরা ও মাঝারি ব্যবসায়ীও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। অনেক সময় যৌক্তিক সীমার বাইরে গিয়ে দাম বাড়ানো হয়।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ায়।

তিনি ২০২৩ সালের রমজানের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, সরকার যখন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, তখন রাতারাতি ব্রয়লার মুরগির দাম কমে গিয়েছিল। এর অর্থ, দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল কৃত্রিমভাবে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন বলেন, তারা বহুবার সরকারকে বাজার মনিটরিং ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবে যা হচ্ছে, তা শুধুই লোকদেখানো অভিযান।

তিনি আরও বলেন, “মনিটরিংয়ের নামে শুধু কিছু নির্দিষ্ট পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান চালানো হচ্ছে, যা কার্যকর বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। আর অভিযানের পর কোনো ফলো-আপ থাকে না, ফলে স্থায়ী সমাধান আসে না।”

সরকার কি এর সমাধান করতে পারবে?

বিগত বছরগুলোতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে—অভিযান, অস্থায়ী মূল্য নিয়ন্ত্রণ, এমনকি আমদানির ব্যবস্থাও করেছে। কিন্তু এগুলো স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সমস্যার মূল কারণ—বড় কর্পোরেটদের আধিপত্য ও সঠিক চাহিদা নিরূপণের অভাব। কিন্তু সরকার এসব সমস্যার গভীরে না গিয়ে স্বল্পমেয়াদী সমাধানেই বেশি মনোযোগ দেয়।

মোয়াজ্জেম দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য একটি ডিজিটাল বাজার পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়েছেন, যা সরবরাহ ও চাহিদার (রিয়েল-টাইম) তথ্য প্রদান করবে। ফলে দাম বেড়ে যাওয়ার আগেই সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে। তবে এই ব্যবস্থা শিগগিরই চালু হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

মোয়াজ্জেম বলেন, “বড় কর্পোরেট গ্রুপ ও সরকারের মধ্যে গভীর সম্পর্ক থাকায় বাজারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এই চক্র কি থামবে?

১৮ কোটি মানুষের এই দেশে রমজানে দাম বাড়বে—এটাই যেন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গেছে।
কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক চাপে ও মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য এটি এখন আরও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।

এদিকে, গত চার বছরের ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রমজান শুরুর এক সপ্তাহ পর বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে আসে বা কিছু পণ্যের দাম কমে যায়।

এই বছরও যদি একই প্রবণতা দেখা যায়, তাহলে রমজানের এক সপ্তাহ পর দাম কমতে পারে। তবে বাজার কারসাজি ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ঠিক না হলে, আগামী বছরও এই একই চিত্র দেখতে হতে পারে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..

© All rights reserved © 2009-2022 bddhaka.com  # গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ের বিধি মোতাবেক নিবন্ধনের জন্য আবেদিত # এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Theme Developed BY ThemesBazar.Com