নিউজ ডেস্ক : কুমিল্লায় নবম শ্রেণিতে পাঠরত অবস্থাতেই মোসারাত জাহান মুনিয়া পাশের গ্রামের নিলয় নামের এক যুবকের গলায় ঝুলে পড়েছিলেন। বিবাহিত, দুই সন্তানের জনক নিলয়ের হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে অজানা উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন, শুরু করেছিলেন দাম্পত্য জীবন। কিন্তু মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় নিলয়কে আসামি করে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা রুজু করেন। মামলায় বলা হয়, আমার অপ্রাপ্ত বয়স্ক বোনকে ফুসলিয়ে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে তার সম্ভ্রম লুটসহ জানমালের ভয়াবহ ক্ষতির শঙ্কা করছি। দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস পরে কুমিল্লার পুলিশ ফেনীতে নিলয়ের এক আত্মীয় বাড়িতে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করে আনে মুনিয়াকে। কিন্তু ততদিনে মুনিয়া-নিলয় রীতিমতো বিয়েশাদি করে ঘরসংসার শুরু করে দিয়েছিল। পরে স্থানীয়দের মধ্যস্থতায় গ্রাম্য বৈঠকে মোটা অঙ্কের জরিমানা আদায়ের মাধ্যমে নিলয়-মুনিয়ার বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটানো হয় এবং যে যার পরিবারে ফিরে যায়।
নিলয়ের সঙ্গে পালিয়ে থাকা থাকাবস্থায় বেশ কিছুদিন রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় নিলয়ের বন্ধু হিরুর আশ্রয়ে অবস্থান করতে হয়েছিল মুনিয়াদের। তার মাধ্যমেই বিএফডিসিতে আসা-যাওয়া, শুটিং, আড্ডাবাজি, নাচ-গান, ফুর্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে মুনিয়া। এবার সে শোবিজের প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। কিন্তু এর মাঝেই বোনের অপহরণ মামলায় পুলিশি তৎপরতায় কোথাও পালিয়ে থাকার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষমেষ নিলয়ের আত্মীয়ের বাড়ি ফেনীর পল্লীতে গিয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করে তারা।
নিলয়ের সঙ্গে প্রেম-বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর দুই বছর বড় বোনের কাছে থেকে পড়াশোনা চালালেও এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই মুনিয়া পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকার উদ্দেশে। নিলয়ের হাত ধরে পরিচিত হিরু মিয়ার মাধ্যমে শোবিজ জগতে ওঠা-বসা শুরু হয় তার, আর পেছনে তাকাতে হয়নি মুনিয়ার। এরপর একের পর এক প্রেমিক বদলে মুনিয়া হয়েছে অভিজাত, বোন-ভগ্নিপতিকে বানিয়েছে ধনাঢ্য। পিয়াসা সিন্ডিকেটের সদস্য মোসারাত জাহান মুনিয়া হয়ে উঠছিলেন আরেক পাপিয়া? হাতবদল আর একটার পর একটা প্রেমিক পাল্টানোর মাধ্যমে মুনিয়া যেমন আভিজাত্যের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন তেমনি নিজের বোন-ভগ্নিপতিকেও ধনাঢ্য করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মা-বাবা মৃত্যুর পর এই বোন-ভগ্নিপতিই ছিল তার একমাত্র অভিভাবক। কিন্তু দুহাতে অঢেল টাকা কামানোর ধান্ধায়, অর্থবিত্তের লোভে মুনিয়ার জীবন কোথায় পৌঁছে যাচ্ছে সে খবর নেওয়ার কোনো দরকারই তারা মনে করেননি। বরং ছোট বোনকে যথেচ্ছ চলাচল, যার সঙ্গে খুশি দিন-রাত যাপনের অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে বোন-ভগ্নিপতি হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
মুনিয়ার নেশা ও পেশা ছিলো একের পর এক পুরুষ শিকার ও টাকা কামানো। বহু হাত ঘুরতে ঘুরতে তার এ মর্মান্তিক পরিণতি। আত্মহনন।
রাজধানীর গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকেই টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয় মুনিয়া। কুমিল্লার একটি সাধারণ পরিবারের মেয়ে মোসারাত জাহান মুনিয়া। তার পুরো পরিবার কুমিল্লায় থাকলেও ২০১৭ সাল থেকেই ঢাকায় একাকী থাকছেন তিনি। এসএসসি পাসের পর থেকেই মুনিয়ার স্বপ্ন ছিল সিনেমায় কাজ করার। এক প্রযোজকের হাত ধরে পরিচয় হয়েছিল ঢাকাই সিনেমার এক নায়কের সঙ্গে। তার সঙ্গে অল্প কিছুদিন লিভ টুগেদারের পর তার আকাশ কুসুম স্বপ্নজাল হঠাৎ ছিন্ন হয়। সেই অভিনেতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে ছেদ পড়তেই বেসামাল হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে অভিনেতা বাপ্পী রাজের সঙ্গে পরিচয় হয় মুনিয়ার। পরিচয় থেকে গভীর প্রেম। বাপ্পীর মিরপুরের বাসায় নিয়মিত একান্তে দেখা হতো তাদের। ওই বাসাতেই শোবিজের অনেকের সঙ্গেই আড্ডায় মেতে উঠতেন তারা। সেখানেই তাদের গ্রুপভিত্তিক নানারকম সম্পর্কের মজাদার সব কাহিনি ছড়িয়ে আছে শোবিজের অন্দরে-বাইরে। এক দিন দেখা গেল প্রেমিকা মুনিয়া বিয়ের দাবিতে বাপ্পীর বাসায় গিয়ে ধরনা ধরে। সেখানে টানা দুদিন অবস্থানের পর আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করে সে। পরে বাপ্পী রাজের বন্ধু-বান্ধবীরা বুঝিয়ে-শুনিয়ে মুনিয়াকে বাপ্পী রাজের বাসা থেকে বের করে নিয়ে যান।
জানা যায়, এরপর থেকেই অভিনেতা বাপ্পী রাজের কাছ থেকে উধাও হয়ে যায় মুনিয়া। তারপর এক সঙ্গীতশিল্পীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠলেও মুনিয়া যোগ দেয় পিয়াসা সিন্ডিকেটে।
মুনিয়াকে নিয়ে যা বললেন বাপ্পী রাজ: মুনিয়ার সঙ্গে প্রেমের বিষয়ে বাপ্পী রাজ বলেন, ‘আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি মন থেকে ওকে পছন্দ করতাম। আমার পুরো পরিবার বিষয়টি জানত। সম্পর্কের মাঝে হঠাৎ গ্যাপ হয়ে গেল। তারপর মুনিয়া কোথায় যেন হারিয়ে গেল।’ বাপ্পী রাজ আরও বলেন, ‘গত বছর আমি খুলনাতে ছিলাম। এখনও খুলনাতেই আছি। তখন বলেছিল, আমরা বিয়ে করেছি। তারপর চার-পাঁচ দিন টানা কথা হয়েছিল আমাদের, ও সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইছিল। তারপর আবার রাগ করে ব্লক করে দেয়।’
আপনার সঙ্গে কবে নাগাদ সম্পর্ক ছিল? আর মুনিয়া তখন কিসে পড়ত? জানতে চাইলে বাপ্পী আরও বলেন, ‘২০১৭-১৮ সালে, দুই বছর আমাদের সম্পর্ক ছিল। আসলে তো লুকোচুরি লুকোচুরি ভাবেই আমার ওর বিষয়গুলো শেয়ার করত। ওর বোনের (নুসরাত) সঙ্গেও ফেসবুকে আমার কথা হয়েছে। আগের আইডিটি এখন আর নেই।’
বাপ্পী রাজ ছাড়াও একাধিক প্রেমের সম্পর্ক ছিল মুনিয়ার। সে বেশ আড্ডাবাজ ছিল। সব ধরনের আসরেই ওঠাবসা ছিল তার। গুলশানের ওয়েস্টিনে নিয়মিত আড্ডাবাজির কারণে বহুল আলোচিত পাপিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। কিন্তু অতিমাত্রার উচ্চাভিলাষী মুনিয়ার আশপাশে থাকা নিরাপদ মনে করেননি পাপিয়া। তাই পাপিয়া নিজেই সরে যান মুনিয়ার পাশ থেকে। ওই সময় পাপিয়া তার ঘনিষ্ঠজনদের বলতেন, এই মেয়ে (মুনিয়া) বড়ই ভয়ঙ্কর, সে সাপের মুখেও চুমু খায়, ব্যঙের মুখেও চুমু খায়।’ পাপিয়ার সে অগ্রিম বার্তাকেও সত্য হিসেবেই প্রমাণ করে ছেড়েছেন মুনিয়া। হুইপপুত্র শারুনের সঙ্গেও অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। মুনিয়াকে দিয়ে একজন শিল্পপতির পুত্রকে ছবি দিয়ে ব্লাকমেইল করাতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন হুইপ পুত্র শারুন। বিভিন্ন সময়ে শারুনের কাসাথে মুনিয়ার কথোপকথনের প্রমাণাদি এখন পুলিশের হাতে। এর ভিত্তিতে ইতোমধ্যেই হুইপপুত্র শারুনকে পুলিশ এক দফা জিজ্ঞাসাবাদও করেছে।
হুইপপুত্র শারুনের সঙ্গেও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক মুনিয়ার: গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের পর আত্মহত্যায় প্ররোচনা মামলার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া হুইপপুত্র শারুন চৌধুরীর সঙ্গে মুনিয়ার কিছু কথোপকথনের স্ক্রিনশটের সূত্র ধরে গত মঙ্গলবার বিকালে একটি সূত্র তার কাছে কিছু তথ্য জানতে চায়। শারুন সরকারদলীয় হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে শারুনের বিরুদ্ধে। ওই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন শারুন।
সূত্র: দৈনিক সময়ের আলো