রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়ায় মালপাহাড়িয়া মহল্লায় ৫৩ বছর ধরে বসবাসকারী পাহাড়িয়া পরিবারগুলোর উচ্ছেদ চেষ্টার প্রতিবাদে শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) একটি শক্তিশালী মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতৃত্বে সকালে সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে অনুষ্ঠিত এই মানববন্ধনে বক্তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—যদি কেউ পাহাড়িয়াদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করে, তবে তা সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করা হবে। এই সংগ্রাম আদিবাসী অধিকার রক্ষা ও জমি খেকোদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদের ডাক তুলেছে, যা বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনে নতুন দিক নির্দেশ করতে পারে।
ঘটনার প্রেক্ষাপট: ৫৩ বছরের ইতিহাসের হুমকি
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে ছয়টি পাহাড়িয়া পরিবার এই ১৬ কাঠা জমিতে বসবাস শুরু করেন, যা সময়ের সাথে ১৬টি পরিবারে পরিণত হয়েছে। এই এলাকা স্থানীয়ভাবে ‘আদিবাসীপাড়া’ হিসেবে পরিচিত। তবে দুই বছর আগে স্থানীয় ব্যক্তি সাজ্জাদ আলী জমির মালিকানা দাবি করে তাদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা শুরু করেন, দাবি করে যে তিনি ১৯৯৪ সালে এই জমি কিনেছেন। তিনি ৩০ লাখ টাকা পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) খাসি ভোজের মাধ্যমে পাহাড়িয়াদের ‘বিদায়’ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সময়ে বাকি ১৩ পরিবারকে উচ্ছেদ করা। এর আগে তিনটি পরিবার ভয়ে জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
গত বুধবার আজকের পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয়। পুলিশ-প্রশাসন বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) তৎপর হয়ে ওঠে, এবং শুক্রবার সকালে আদিবাসী সংগঠন, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও উন্নয়নকর্মীরা মহল্লায় মানববন্ধন করেন। এর ফলে খাসি ভোজের আয়োজন ভেস্তে যায়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে দলীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়ে বিকেলে তাদের মহল্লায় পাঠান, যা উচ্ছেদের চেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
মানববন্ধনের শক্তি: সমাজের সমন্বয়
শনিবার সকালে সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আয়োজনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দিনের আলো হিজড়া সংঘ, হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার নেটওয়ার্ক, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম ও সবুজ সংহতি সংহতি জানিয়েছে। ভুক্তভোগী পাহাড়িয়া পরিবারগুলোও এতে অংশ নিয়েছেন। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি গণেশ মার্ডির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তারা পাহাড়িয়াদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ জানান।
পাহাড়িয়া পরিবারের সদস্য ময়ূরী বিশ্বাস আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, “এই জমিতে আমাদের দাদারা বাস করেছেন, আমাদের বাবারাও বাস করেছেন। এখন আমরা বাস করছি। জমির প্রকৃত মালিক ইন্দ্রা ধোপা ভারতে মারা গেছেন, আর সাজ্জাদ আলী এখন দাবি করছেন। আমরা এতদিন আগে থেকে এখানে আছি, যখন শহর প্রায় ফাঁকা ছিল—এত দিন পর কেন এই দাবি?” তিনি জমির ইতিহাস ও তাদের অধিকারের প্রতি জোর দেন।
প্রতিবাদের কণ্ঠ: আদিবাসী অধিকারের দাবি
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সহসভাপতি রাজ কুমার শাও বলেন, “সাজ্জাদের দলিল সঠিক নয়। এটি আদিবাসীদেরই জায়গা। সিটি করপোরেশন এখানে শৌচাগার ও টিউবওয়েল স্থাপন করেছে—ব্যক্তিগত জমিতে এমন কিছু হয় না। ৫৩ বছর ধরে বসবাসের পর তাদের জমি বন্দোবস্ত করা উচিত।” পাহাড়িয়া মহল্লার সর্দার বাবুল বিশ্বাস বলেন, “সাজ্জাদ আমাদের ভয় দেখিয়েছেন, অল্প টাকা দিয়ে উচ্ছেদের চাপ সৃষ্টি করেছেন। আমরা ভয়ে চলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু এখন সবাই পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমরা এখানে জন্মেছি, এখানেই মরতে চাই।”
জুলাই ৩৬ পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ জামাল কাদেরী মানবাধিকার লঙ্ঘনের দাবি তুলে বলেন, “তিন প্রজন্ম বাস করার পর কাউকে উচ্ছেদ করা অসম্ভব। এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে হবে।” জাতীয় মহিলা পরিষদের জেলা সভাপতি কল্পনা রায়, পরিবর্তনের পরিচালক রাশেদ রিপন ও উন্নয়নকর্মী সম্রাট রায়হান আজকের পত্রিকাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “আপনাদের সংবাদের জন্যই আমরা এ সমস্যা জানতে পেরেছি। গণমাধ্যম অসহায়দের পাশে থাকুক।”
সমাজের সমন্বয়: বহুমুখী সমর্থন
মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন রাজশাহী প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন, উদীচীর সহসভাপতি অজিত কুমার মণ্ডল, আইনজীবী মাহাবুবুর রহমান, বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রচেষ্টার নির্বাহী পরিচালক ফয়জুল্লাহ চৌধুরী, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাবেক সভাপতি বাবুল রবিদাস, কোষাধ্যক্ষ সুধীর তির্কি, গোদাগাড়ী উপজেলার সভাপতি রবীন্দ্রনাথ হেমব্রম, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান, সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সুলতানা আহমেদ সাগরিকা, জুলাইযোদ্ধা ঈষিতা পারভীন ও যুবনেতা উপেন রবিদাস। তাদের বক্তব্যে পাহাড়িয়াদের অধিকার রক্ষা ও সমাজের ঐক্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
গভীর প্রভাব: আদিবাসী আন্দোলনের নতুন দিগন্ত
এই মানববন্ধন পাহাড়িয়াদের উচ্ছেদ বন্ধের জন্য একটি শক্তিশালী সংকেত। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের হস্তক্ষেপের পর সাজ্জাদের পরিকল্পনা ভেস্তু হলেও, পাহাড়িয়াদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বজায় আছে। এই ঘটনা বাংলাদেশে আদিবাসীদের জমি দখল ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় আন্দোলনের সূচনা হতে পারে, যেখানে সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে সমর্থন পাওয়া গেছে।
এই উচ্ছেদ চেষ্টা রোধে সরকারকে আদিবাসীদের জমি বন্দোবস্তে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। জমির কাগজপত্র যাচাই করে সাজ্জাদের দাবি খারিজ করা, পাহাড়িয়াদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এবং মানবাধিকার সংগঠনের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনের সমর্থন অব্যাহত থাকলে এই সংগ্রাম সফল হতে পারে।