রাজশাহী সংবাদদাতা : সীমান্ত দিয়ে চোরাচালানের তালিকায় এবার যোগ হয়েছে গরুর মাংস। কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই চোরাই পথে আনা এসব মাংস হাটেবাজারে বিক্রি হচ্ছে। দাম পড়ছে কেজিপ্রতি ৪০০ টাকা। দামে সস্তা হওয়ায় এর চাহিদাও বাড়ছে সীমান্ত এলাকায়। স্থানীয় হোটেল রেস্তুরাঁগুলোতেও এ মাংস সরবরাহ করা হচ্ছে। এমনকি, বড় বড় সামাজিক অনুষ্ঠানে মাংস সরবরাহের অর্ডার নিচ্ছে চোরাকারবারিরা। নৌকায় করে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে মাংস আনা হচ্ছে।
রাজশাহীতে সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান ভারতীয় গরুর মাংসে
জানা গেছে, গরু আসা বন্ধ হওয়ায় এখন মাংসের দিকে ঝুঁকছে চোরাকারবারিরা। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড সদস্যরা মাত্র দুদিনের ব্যবধানে প্রায় ১৫ মণ মাংস জব্দ করেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কোনো মাংস খাওয়া উচিত নয়। আর দীর্ঘসময় পথিলিন বা বস্তার মধ্যে মাংস বদ্ধ থাকলে গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। এ ধরনের মাংস খেলে হুমকিতে পড়তে পারে স্বাস্থ্য।
রাজশাহী বিজিবি ১ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে কর্নেল সাব্বির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের কাছাকাছি ভারতের গ্রাম ও বাজারগুলোতে চোরাকারবারিরা গরু জবাই করে মাংস পাঠিয়ে দিচ্ছে। গরু আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একটি সিন্ডিকেট তাদের কৌশল পাল্টেছে। তবে সীমান্তের বিজিবির ‘রিভার টহল’ জোরদার করা হয়েছে। যেসব নৌকা এপারে এসে ভিড়ছে সেগুলোতেও তল্লাশি করা হচ্ছে। এ ছাড়া সন্দেহভাজনদের তালিকা করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানায়, বাঘা উপজেলার আলাইপুর-মীরগঞ্জ সীমান্ত পথ দিয়ে সরাসরি ভারতে জবাই করা গরুর মাংস আসে বাংলাদেশে। সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে গরু জবাই করা হয়। এর পর পলিথিনের প্যাকেটে করে চোরাই পথে সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকানো হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও নিজের প্রয়োজনে ভারতীয় মাংস কিনছেন অনেকেই। হোটেলেও বিক্রি করা হচ্ছে ভারতীয় মাংস। মঙ্গলবার এ এলাকা থেকে ১২ মণ ভারতীয় গরুর মাংস জব্দ
করেছে বিজিবি। এর আগেও দুই দফায় কয়েক মণ মাংস জব্দ করা হয়।
বাঘার আমানুল হক নামের এক ব্যক্তি জানান,তার বোনের বাড়ি আলাইপুর সীমান্ত এলাকায়। সেখানে বেড়াতে গিয়ে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছেন তিনি। পরে জানতে পারেন-এগুলো ভারত থেকে আসা মাংস। তবে দেশীয় মাংসের মতো স্বাদ নেই। প্রায় দিনই চোরাই পথে ভারত থেকে গরুর মাংস এনে বিক্রি করা হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা নুরুজ্জামান জানান, সস্তায় মাংস মিলছে। এ কারণে চাহিদাও বেড়েছে। যে কোনো অনুষ্ঠানের জন্য ভারতীয় মাংসেরই ব্যবস্থা করছে সীমান্তবাসী। আগে থেকেই অর্ডার দিলে চাহিদামতো সরবরাহ করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। প্রকাশ্যে চোরাই মাংস বিক্রি করা হয় না। বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। তবে কারা এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত সে বিষয়ে মুখ খুলতে চান না কেউই। ভারতীয় গরুর মাংস প্রতিকেজি ৪০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। খায়রুল নামের এক ভারতীয় মাংস ক্রেতাকে পাওয়া গেলেও তিনি মুখ খোলেননি।
দেশীয় গরুর মাংস ব্যবসায়ী সাজেদুল ইসলাম জানান, ভারত থেকে গরুর মাংস আমদানির কারণে আমাদের বিক্রিও কমে গেছে। চোরাকারবারি, ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতা ও নৌকার মাঝিদের রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। দুই দেশের চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেট যোগাযোগ করে নদীপথে গভীর রাতে আনা হয় মাংস। তবে নৌকার ওপরে প্রকাশ্যে নয়। মাছ ধরার ছলে নৌকায় মাংস আসছে। আলাইপুর-মীরগঞ্জ সীমান্ত এখন তাজা মাংসের অন্যতম প্রধান রুট।
ভারত থেকে চোরাইপথে মাংস আসার বিষয়ে বাঘা উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেরাজুল ইসলাম বলেন, ভারতে থেকে অবৈধপথে বেশ কিছুদিন ধরেই গরুর তাজা মাংস আসছে। সীমান্ত এলাকার গ্রাম ও হাটবাজারগুলোকে ঘিরে এ মাংসের ক্রেতাও তৈরি হয়েছে। দামে খানিকটা কম পাওয়ায় অনেকেই এ মাংস কিনছেন। সপ্তাহখানেক আগে মাংস পরিবহনের সময় হাতেনাতে এক ব্যক্তিকে ধরে প্রশাসনের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘অবৈধপথে মাংস আসার বিষয়টি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভাতেও আমি অবহিত করেছি।’
বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আখতার বলেন, ‘ভারতীয় মাংস আসার বিষয়টি আমার আগে জানা ছিল না। বিষয়টি জানার পর সভায় উপস্থিত আলাইপুর ও মীরগঞ্জ সীমান্ত এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ বাঘা থানার অফিসার ইনচার্জকে গুরুত্বসহকারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া বাজারগুলোতে মনিটরিং করা হচ্ছে।’
আলাইপুর সীমান্তের বিজিবির কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার আব্দুর রব বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা সপ্তাহের সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার ভারতে গরু জবাই করে বাংলাদেশে মাংস নিয়ে আসছে বলে জেনেছি। দুই দেশেরই লোক একাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।’
ভারত থেকে গরুর মাংস আসার খবর জানা নেই বলে মন্তব্য করেছেন রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন।