বিডি ঢাকা ডেস্ক
প্রমত্ত্বা যমুনার উপর নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর পশ্চিম অংশে ৫ ও ৬ নম্বর পিলারে ৪৯তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু পুরোটাই দৃশ্যমান। আগামি আগস্টে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানোর লক্ষ্য নিয়ে এখন ফিক্সিং ও ট্র্যাক বসানো হচ্ছে- একইসঙ্গে টেলিকমিউনিকেশনের কাজ সহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করা হচ্ছে। আগামি ডিসেম্বরে নির্ধারিত সময়ে বৃহৎ এ সেতু উদ্বোধনের আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া দু’পাশের ১৩ কিলোমিটার রেললাইনের অর্ধেকাংশ শেষ হয়েছে এবং বাকি ৫০ শতাংশের কাজ দ্রুতগতিতে করা হচ্ছে।
সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম স্টেশনের কাজও অর্ধাংশ শেষ হয়েছে এবং বাকি ৫০ শতাংশের কাজ শেষ করতে দিনরাত সংশ্লিষ্টরা পরিশ্রম করছে। ফলে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক রেলওয়ে রুট এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথ নেটওয়ার্ক এখন আর স্বপ্ন নয়- হাতের মুঠোয় চলে আসছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমানের মতে, এ সেতু নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে(ঞঅজ) নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে আর তেমন কোন বাঁধা রইল না। ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে(ঞঅজ) নেটওয়ার্ক হচ্ছে- ইউরোপ এবং এশিয়া জুড়ে একটি সমন্বিত মালবাহী রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করার একটি প্রকল্প। প্রকল্পটি ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (টঘঊঝঈঅচ) এর।
তিনি মনে করেন, ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হতে যাচ্ছে। বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রাম ও পর্যটন নগরী কক্সবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। এই নেটওয়ার্ক চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত। পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলো- ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়াও এ নেটওয়ার্কের আওতায় রয়েছে।
সরেজমিনে দেখাগেছে, ডিসেম্বরে মহান বিজয় দিবসকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতু সংশ্লিষ্টরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। এ সেতুর নির্মাণ শ্রমিক আবু হানিফ। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলা সদরে। চার সদস্য বিশিষ্ট তার পরিবার। আগে একটি তাঁত ফ্যাক্টরীতে কাজ করতেন। করোনার সময় সে তাঁত ফ্যাক্টরী বন্ধ হয়ে যায়। এতে বেশ কিছুদিন বাড়িতে বসে ছিলেন। চার জনের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম তিনি। কাজ নেই তাই সংসারে অভাব-অনটন দেখা দেয়। তিনি একটা কাজ খুঁজছিলেন। বিভিন্ন জনের কাছে ঘুরে খোঁজখবর নিয়ে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে নির্মাণ শ্রমিকের চাকরি নেন। বঙ্গবন্ধু সেতুর রেলট্যাগে শুরু থেকেই কাজ করছেন তিনি। মধ্য বয়সী আবু হানিফ জানান, বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে কাজ করে তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। এত বড় কাজের একজন শ্রমিক হয়ে তিনি কাজ করছেন- এটা আল্লাহর অপার রহমত। রেল সেতুতে তার মতো আরও বহু শ্রমিক কাজ করছেন। এ কাজ করার পর থেকে তার সংসার ভালো চলছে। সেতুতে তিনি রেলের ক্যাবল ও ক্লিপ লাগানোর কাজ করেন। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে খুব কষ্ট নিয়ে তাকে কাজ করতে হচ্ছে। তারপরও তো কাজ করতে হবে- তার উপর নির্ভর করছে সংসার। সেতুতে কাজের জন্য মাসে ১৩-১৪ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের যে দাম সে অনুযায়ী তাদের পোষায় না। তাদের বেতন ১৮-২০ হাজার হলে পরিবার নিয়ে ভালো ভাবে চলতে পারবেন। তারপরও কষ্টের মাঝেও আনন্দ পান- কারণ দেশের এত বড় একটা রেল সেতুর তিনিও অংশিদার। তার পরিবার ও তিনি গর্ব করে বলতে পারছেন- বৃহত্তর রেলসেতু নির্মাণে তিনি কাজ করছেন। দেশের জন্য কাজ করছেন- এজন্য অনেক ভালো লাগে। বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ কাজে আবু হানিফের মতো বিভিন্ন পদে নিয়োজিত রয়েছেন শ’ শ’ শ্রমিক।
সরেজমিনে দেখা যায়, দিনরাত বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে। শ’ শ’ শ্রমিক সেতুতে কাজ করছে। কেউ পাথর টানছে, কেউ ফিক্সিং করছে, আবার কেউ ট্র্যাক বসাচ্ছে। টেকনিশিয়ানরা কাজের তদারকি করছেন। একইসঙ্গে সেতুতে টেলিকমিউনিকেশনের কাজও চলছে। এভাবেই বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। সেতুর এক দক্ষ শ্রমিক শহিদুল ইসলাম জানান, এর আগে তিনি অন্য জায়গায় সেতু নির্মাণে কাজ করতেন। যমুনা নদীর ওপর রেল সেতুর কাজ শুরু হলে তিনি তখন চাকরি নেন। বঙ্গবন্ধু রেলসেতুতে বেতন ভালো হওয়ায় এখানেই রয়েছেন। তিনি ১৮-২০ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন। পরিবার নিয়ে বর্তমানে অনেক সুখে আছেন। এখানে দিনরাত প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে কাজ করতে তার অনেক কষ্ট হয়। তারপরও ছেলে মেয়ে গর্ব করে বলতে পারে তাদের বাবা বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে কাজ করছে। তিনি আরও জানান, এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। মেয়ে এমএ পাস করেছে। ছেলে অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের চাকরি হলে তার স্বপ্ন পূরণ হবে।
তখন আর এতো পরিশ্রম না করলেও চলবে। রেলসেতুতে সাধারণত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। কোন কোন সময় রাতেও কাজ করতে হয়। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর তার বাড়ি। বাড়ি থেকে এসে তিনি ডিউটি করতে পারেন। তিনি কাজের পাশাপাশি পরিবারকেও সময় দিতে পারেন। এখানে কাজ করতে কষ্ট হলেও তিনি অনেক আনন্দ পান। তিনি পদ্মা সেতুতে কাজ করেছেন, বরিশালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করেছেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুতে কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে এতো বড় রেল সেতু নির্মাণ হচ্ছে। তারাও কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর কাজ শেষ হওয়ার পর আবার কোথায় যাবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এই কাজ শেষ হওয়ার পর কি করবেন- তা তিনি জানেন না। মহান আল্ল¬াহ যেখানে কর্ম কপালে রেখেছেন সেখানেই যাবেন।
অপর শ্রমিক আবু রাজ্জাক জানান, তিনি ২৪ বছর টেক্সটাইল ফ্যাক্টরীতে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেছেন। ছায়ার মধ্যে সব সময় থাকতেন। ওই কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে চাকরি করছেন। এখানে শীত-বর্ষায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও রোদে পুড়ে কাজ করতে হচ্ছে। তবুও পেটের তাগিদে কষ্ট করে কাজ করতে হয়। কাজ না করলে বউ-পোলাপান খাবে কী? প্রতিদিন ৮ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। যা বেতন পান তা দিয়ে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা সহ সংসার খরচ চলে যায়। বেতন বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
জানা যায়, যমুনা নদীর ওপর নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর শেষ ৪৯তম স্প্যানটি বসেছে ২০ এপ্রিল(শুক্রবার)। এর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে দেশের দীর্ঘতম রেলসেতুর পুরো অবকাঠামো। রেলসেতুতে যুক্ত হয়েছে যমুনা নদীর দুই তীর। এখন রেলপথ বসানো সহ আনুষঙ্গিক কাজ চলছে। এসব শেষ হলে আগস্ট মাস নাগাদ এ সেতু দিয়ে প্রথমে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলবে। এরপর ডিসেম্বরের মহান বিজয় দিবসের দিনে সেতুর উদ্বোধন হতে পারে। উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেলযাত্রীরা এখন সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। রেলওয়ে প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর পশ্চিম অংশে ৪৯ তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। আর প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৮৪ শতাংশ। অবশিষ্ট কাজ শেষে আগামি আগস্ট নাগাদ পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল ও ডিসেম্বরে সেতু দিয়ে নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু দিয়ে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর ন্যূনতম ৩০ মিনিট (ক্ষেত্র বিশেষে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত) সময় সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে দিনে কমপক্ষে ৮৮টি ট্রেন দ্রুতগতিতে সেতু পারাপার হতে পারবে। বঙ্গবন্ধু রেলসেতুতে সর্বশেষ স্প্যান বসানোর পর থেকে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং সেতুর পূর্বাঞ্চলের মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাসের হাওয়া বইছে। দেশি-বিদেশি পাঁচ হাজারের বেশি প্রকৌশলী-শ্রমিক দিন-রাত সুদক্ষভাবে সেতু বাস্তবায়নে কাজ করছে। দেশের বৃহৎ রেল সেতু নির্মাণের সাক্ষী হতে পেরে তারাও উচ্ছ্বসিত।
সূত্রমতে, বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু দিয়ে বর্তমানে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে প্রতিদিন ৩৯টি ট্রেন পারাপার হয়। এতে সময় অপচয়ের পাশাপাশি শিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়। তবে নতুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর প্রতিদিন ৮৮টি ট্রেন ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করবে। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে রেলপথে পণ্য পরিবহণের সুবিধা বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ রুটে সহজে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ সহ সার্ক, বিমসটেক, সাসেক ও অন্যান্য আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক রেলওয়ে রুট এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথ নেটওয়ার্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ২০২০ সালে যমুনা নদীর ওপর এবং বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুর ৩০০ মিটার উত্তরে টাঙ্গাইল অংশের ভূঞাপুর উপজেলা ও সিরাজগঞ্জের অংশে পৃথক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ সেতুর দেশীয় অর্থায়ন ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দিয়েছে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা- যা প্রকল্পের ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ। মূল সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাপানি কোম্পানি ওটিজি ও আইএইচআই জয়েন্টভেঞ্চার। সেতুর ৮৪ শতাংশের পাশাপাশি দু’পাশের ১৩ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম স্টেশনের কাজও ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে।
সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান জানান, মূল সেতুর অবকাঠামোর কাজ শেষ। ফলে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ শেষে টেস্টিং, কমিশনিং করে ডিসেম্বরে বা জানুয়ারির(২০২৫) প্রথম সপ্তাহের দিকে সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল উন্মুক্ত করে দেওয়া হতে পারে। রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শেখ নাইমুল হক জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর ভৌত কাজ ৮২ শতাংশ শেষ হয়েছে। আর্থিক কাজের অগ্রগতি ৬০ দশমিক ৬১ শতাংশ। প্রকল্পের কাজ ডিসেম্বরে শেষ হলেও যাত্রী চলাচল শুরু হতে জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।
তিনি আরও জানান, এখন ফিক্সিং ও ট্র্যাক বসানো হচ্ছে। একইসঙ্গে টেলিকমিউনিকেশনের কাজ করা হচ্ছে। আনুষঙ্গিক কাজগুলো শেষ হলে আগামি আগস্টে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হতে পারে।