ফরিদপুর সংবাদদাতা : ফরিদপুরে জ্বালানি (কয়লা) সংকট ও উচ্চ মূল্যের কারণে চলতি মৌসুমে এখনো ইট ভাটার কাজ শুরু করতে পারেননি মালিকেরা। আর এতে প্রায় বিশ হাজার ইট-ভাটা শ্রমিক বেকার (কর্মহীন) হওয়ার অবস্থা রয়েছে।
জানা গেছে, গত মৌসুমে ভাটা মালিকেরা ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত জ্বালানি (কয়লা) টন প্রতি ক্রয় করেছিলেন সাড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকায়। কিন্তু চলতি মৌসুমে মহামারির কারণে কয়লা আমদানি সংকট রয়েছে। এর মধ্যে যা পাওয়া যাচ্ছে তার ক্রয়মূল্য টন প্রতি দিতে হচ্ছে ১৯ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা। এ জন্য ভাটা মালিকেরা সময় মতো ভাটায় ইট কাটা শুরু করতে পারছেন না।
জেলা ভাটা মালিক সমিতি জানিয়েছে, ফরিদপুর জেলায় ছোট বড় ১২৮টি ইটভাটা রয়েছে। তার মধ্যে ৮টি দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ, চালু রয়েছে ১২০টি। অটো ইটভাটা রয়েছে ৭টি বাকি ১১৩টি ইটভাটা চলে কয়লা পুড়িয়ে।
সরেজমিনে ফরিদপুরে সদর উপজেলার ডিক্রীরচর, নর্থচ্যানেল ও চরমাধবদিয়া ইউনিয়নে বিভিন্ন ইট-ভাটায় গিয়ে দেখা যায়, গত বছরের উৎপাদিত ইট এরই মধ্যে বিক্রি শেষপর্যায়ে। কিন্তু নতুন করে উৎপাদনে না যাওয়ায় ফরিদপুরে ইট সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি উন্নয়নকাজে ঠিকাদাররা ইট কিনে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর নতুন ইট উৎপাদনের পর যে দামে বিক্রি হবে তা বর্তমান বাজার দরের দ্বিগুণ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
জানা গেছে, সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষ সময় থেকে ইট উৎপাদনে যায় ভাটা মালিকেরা। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়েই মাটি কেনা, মাটি থেকে কাচা ইট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। কাচা ইট রোদে শুকিয়ে অক্টোবর মাসেই প্রথম কিস্তি ইট পোড়ানো শুরু করে। কিন্তু নভেম্বর মাস শুরু হয়ে গেলেও ইট উৎপাদন শুরু করতে পারেনি ভাটাগুলো।
ফরিদপুর ডিক্রীরচর ইউনিয়নের ধলার মোড় এলাকার এম এ বি ব্রিকস এর মালিক মো. আব্দুস সালাম জানান, একটি মৌসুমে ৮ রাউন্ডে ৭ থেকে ৮ লাখ করে মোট ৫০ থেকে ৬০ লাখ ইট তৈরি হয়। একেক রাউন্ডে ইট পোড়াতে ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। এ বছর কয়লার দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় মৌসুমের প্রায় ৪৫ দিন পেরিয়ে গেলেও ইট উৎপাদন শুরু করতে পারেননি।
তিনি আরও জানান, প্রতি রাউন্ডে ৭ থেকে ৮ লাখ ইট পোড়াতে প্রায় ১৩০ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। এতে ৮ রাউন্ড পোড়ালে ১ হাজার টনের বেশি কয়লা প্রয়োজন হয়। আগে ১ হাজার টন কয়লা কিনেছি ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকায়। এবার তা কিনতে সোয়া ২ কোটি টাকা লাগবে।
একই কথা বলেন আরেক ভাটা মালিক আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা। তিনি বলেন, গত মৌসুমে একটি ইটের উৎপাদন খরচ ছিল সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৬ টাকার মধ্যে। কিন্তু চলতি মৌসুমে একটি ইট উৎপাদনে ১০ থেকে ১১ টাকা খরচ হবে। নতুন এক হাজার ইটের দাম হবে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা। এত দামে মানুষ ইট কিনবে কি-না সে নিয়েও চিন্তায় রয়েছি ।
শহরতলির সিঅ্যান্ডবি ঘাট এলাকার রউফ ব্রিকসের সুপার ভাইজার মিজানুর রহমান জানান, ইটভাটা করতে হলে বিভিন্ন জেলার ইট প্রস্তুতকারী শ্রমিকদের মৌসুমের কমপক্ষে ছয় মাস আগে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম দিতে হয়। অগ্রিম নেওয়া শ্রমিকেরা কাজ করতে আসতে পারছে না। স্থানীয় শ্রমিকেরাও কোনো রকমে আবার কেউ বেকার হয়ে দিনাতিপাত করছে।
ফরিদপুর জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি খলিফা কামাল উদ্দিন ইট উৎপাদনের এই সংকটের বিষয়ে বলেন, ৮ হাজার টাকার কয়লা ২২ হাজার টাকায় কিনে ভাটা চালু করা ব্যবসায়িক ঝুঁকি মনে করছে ইটভাটা মালিকেরা। ফলে বেশির ভাগ ইটভাটা এই মৌসুমে ইট উৎপাদনে যেতে পারেনি।
তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এখন উদ্যোগ না নিলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে শুরুতে বাজারে যে নতুন ইট আসবে সেই ইটের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
জানা গেছে, ফরিদপুরে ৫ থেকে ৭জন ব্যবসায়ী ইটভাটা গুলোতে কয়লা সরবরাহ করে থাকে। এই ব্যবসায়ীরা ভরা মৌসুমে মোংলা বন্দর থেকে নৌপথে ফরিদপুর সিঅ্যান্ডবি ঘাটে (নৌ বন্দরের) কয়লা নিয়ে আসে। নদী পানি কমে গেলে যশোরের অভয়নগর উপজেলার শিল্প এলাকা নওয়াপাড়া থেকে সড়ক পথে কয়লা আনেন।
ফরিদপুরের কয়লা ব্যবসায়ী মুজিবর মাতুব্বর বলেন, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কয়লা আমদানি করা হয় দেশে। আন্তর্জাতিক বাজারেও কয়লার দাম বৃদ্ধি ও শিপমেন্ট খরচ বেড়ে যাওয়ায় কয়লা আমদানিতে খরচ বেড়েছে। ফলে আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি দামে কয়লা বিক্রি করতে হচ্ছে। মূলত মোংলা ও নওয়াপাড়ার আমদানিকারকদের কাছে থেকে কয়লা এনে ফরিদপুরে বিক্রি করি। এবার দাম বেশি হওয়ায় ফরিদপুরে কেউ কয়লা নিচ্ছে না।